Homeচিঠিপত্রবউ-বিভ্রাট

বউ-বিভ্রাট

রোজকার কাজ সেরে ক্লান্তিকে সঙ্গী করে ঘরে ফিরলেন খালেদ সোহেল। ক্লান্তি সঙ্গী হলেও শান্তি কিন্তু তার হাত ছাড়েনি। ঘরে ঢুকেই বউয়ের যত্ন-আত্তি-ভালোবাসায়, সন্তানের আদরে ক্লান্তিকে ভাগিয়ে শান্তি বেশি জায়গা নেবে, তা জানে খালেদ।

একবার লম্বা, তারপর ছোট ছোট দুবার-ঘরে ফিরে এভাবেই বেল বাজায় খালেদ। অফিস থেকে ফেরার সংকেত। বিশেষ এই বেলের শব্দ শুনে দৌড়ে আসে বউ। প্রতিদিনের প্রতীক্ষায় থাকা বউয়ের এই ব্যাকুলতাটুকু আলোগোছে উপভোগ করে সে। এটুকু তাদের রোজকার রোমান্স। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বউয়ের দৌড়ে আসার শব্দটা শুনে খালেদের ক্লান্তিগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরতে শুরু করে।

ঘরে ফিরেছি, সংকেতের কলিং বেল বাজালো খালেদ কিন্তু বউয়ের দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেল না। আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো তার। আজ কি তবে বিধিবাম? ঝড়ের পূর্বাভাস পেল সে। সাংকেতিক বেল রেখে এবার সরাসারি একবার বেলে চাপ দিলো খালেদ।

মিনিট তিনেক পর দরজা খুললো ছেলে। ছেলের দরজা খোলা দেখে ঝড়ের ব্যাপারে আরও খানিকটা নিশ্চিত হলো। ঘরে ঢোকার পর বুঝতে পারলো, বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিসের মতো পূর্বাভাস নয়, রীতিমতো নাসা থেকে পাওয়া পূর্বাভাস। ঝড় আসবেই, তা-ও আবার যে-সে ঝড় নয়, একেবারে টর্নেডো টাইপের কিছু অপেক্ষা করছে। দূর থেকে বউয়ের মুখ এক ঝলক দেখে রাতে কী হতে চলেছে আন্দাজ করতে পারলো সে।

কথা না বাড়িয়ে দরজার পাশেই রাখা হাতের কারুকাজ করা মোড়ায় বসে মোজা খুলতে খুলতে হিসাব মেলাতে থাকে খালেদ। গতকাল রাতে ঠিকঠাক মশারি টানিয়েছে। সোফায় বসে টিভি দেখা শেষ করে কুশনগুলো ঠিকঠাক সাজিয়ে রেখেছে। সারাঘরের সব সুইচ ঠিকঠাক বন্ধ করে তবে ঘুমাতে গিয়েছে। পরদিন সকালে যে জামাকাপড় পরে অফিস যাবে, এমনকি ছেলের স্কুলড্রেসটাও নিজেই আয়রন করে রেখেছে। সকালে গোসল শেষে বিছানায় ভেজা তোয়েলেও রাখেনি। বউয়ের এক্সপেরিমেন্ট রান্না ‘ইতালিয়ান ক্যাসাটা’ খাওয়ার সময় টু শব্দটি করেনি বরং খাওয়া শেষে চার লাইনের ছড়া কেটে প্রশংসা করেছে—

‘তোমার হাতের জাদু
খাবার হয় সুস্বাদু।
ক্যাসাটা হোক বা কদু,
আহা কী রেঁধেছো বধূ।’

ছড়া শুনে বউয়ের হাসিটা দেখে অতি বিস্বাদ ক্যাসাটাও মধু হয়ে উঠেছিল।

তাহলে সকালবেলার মধুরা, রাতে মন্থরা হয়ে উঠলো কেন? ঘটনা কী? মাথা চুলকায় খালেদ। সূত্র খুঁজে পায় না। ছোটখাট ঝড় নয়; একেবারে টর্নেডো। তাহলে অপরাধও নিশ্চয়ই মস্ত কিছু। তবে বরাবরেরই মতোই ক্লু-লেস খালেদ। জানে না কী তার অপরাধ!

শোবার ঘরে ঢুকে টর্নেডোর মাত্রা কত ভয়ংকর, তা আরও স্পষ্ট হয়। খাটের পাশে ট্রলিব্যাগ গোছানো। বউ কোথাও যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। খালেদ গত বারো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, এখন কোনো প্রশ্নের উত্তরই মিলবে না।

একটু ভেবে তাই রাগ ভাঙানোর তৃতীয় অস্ত্রটা প্রয়োগ করে খালেদ। অপরাধ না জেনেও ‘সরি’ বলে ফেলা। চুপচাপ সব সংশয় কাটিয়ে বউয়ের হাত ধরে, মুখে করুণ আর্তি ফুটিয়ে, চোখে খানিক ভালোবাসা এনে, গাঢ় নরম গলায় সে বলে—সরি।

তৃতীয় অস্ত্র কোনো কাজে আসে না। বুমেরাং হয়ে ফেরত আসে। বউয়ের মুখে জমে থাকা কালো মেঘ, শ্রাবণের মেঘের মতো আরও ঘন কৃষ্ণবর্ণ হয়ে ওঠে। উত্তর মেলে না। কলিজায় সাহস জুটিয়ে বউয়ের কাঁধে হাত রেখে আরও গাঢ়স্বরে খালেদ বলেই চলে, সরি সরি সরি সরি সরি সরি। সরির সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়লো চিৎকারের জোর। খেই হারিয়ে ফেলে খালেদ।

বউ বলে, কীসের সরি? কোনো সরি বলার দরকার নেই। সরি বলে কী প্রমাণ করতে চাও? আমি কাল সকালে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি, ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে।

খালেদ টর্নেডো আশা করেছিল, এ তো সুনামিকেও ছাড়িয়ে গেল। একধাক্কায় বাপের বাড়ি। অন্য সময় বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে শুনলে ক্ষণিকের ব্যাচেলর হয়ে ওঠার ব্যাপারটা ভালো লাগে। এখন কেমন তেতো লাগলো। খালেদ সময় গুনছে—তার অপরাধের ফিরিস্তি কখন পাবে?

সারাজীবন সংসারের জন্য কী কী করেছে, খালেদকে বউ কত ভালোবাসে, জীবনে কত কিছু ছাড় দিয়েছে, শ্বশুরবাড়িকে কত সহ্য করেছে—বিশ মিনিট ধরে সেই ফিরিস্তি দিলো বউ এবং অবশ্যই চিৎকার করে।

‘আমাদের বিছানার অর্ধেকজুড়ে থাকে তোমার বই। শুক্রবার হলেই বইয়ের নেশায় ছুটে যাও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। শাড়ির আলমারির পুরোটাই তোমার বইয়ের দখলে। সব সহ্য করেছি আর না। খালি আমি বলেই তোমার সংসার করে গেলাম। এবার আর সম্ভব না।’

বউয়ের যুক্তি শুনতে শুনতে খালেদ বিড়বিড় করে বলল, ‘তুমি আমার ঘড়ায় তোলা জল আর বই হচ্ছে আমার দিঘি…’

বিড়বিড় করে বলা শব্দ থেকে বউ কেবল শুনতে পায় দিঘি। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো সে।

‘দিঘি? দিঘি? আনা? আর কত কী দেখতে হবে?’

বউ তার বহ্মাস্ত্র বের করলো। বউয়ের চোখে দিঘির জল ফোয়ারা হয়ে নামল। ঝগড়ার প্রথম ধাপ শেষে অনুশোচনায় মিইয়ে গেল খালেদ। বউয়ের চোখে জল, সে যে মহাশাস্তি।

বিজ্ঞাপন

টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু এগিয়ে দিলো খালেদ। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দ্বিতীয় ধাপে মিনিট দশেক চোখের পানি ঝরালো বউ। মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে বউয়ের কান্না দেখলো খালেদ। হঠাৎ বউ শাড়ির আঁচলের গিট খুলে বেঁধে রাখা একটি কাগজ ছুড়ে দিলো তার দিকে।

বাতিঘর থেকে কেনা নীল রঙের হ্যান্ডমেড কাগজে লেখা গতরাতে চিঠিটা দেখে যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল সে। চিঠিটার জান যায় যায় অবস্থা। কাগজটার ওপরে কত ঝড় গেছে আন্দাজ করতে পারলো সে। পরম যত্নে কুড়িয়ে নিয়ে তার নিজের হাতে লেখা চিঠি।

বউ বলে, ‘তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। যে তোমার আকাশজুড়ে ছিলাম কেবল আমি, সেখানে এখন আনা। কী ভেবেছো এত সহজে ছেড়ে দেবো? আনা আসুক ফানা আসুক আর কানা আসুক—এত সহজে তোমাকে আমি ছাড়বো না, মজা দেখিয়ে ছাড়বো?’

খালেদ নিজেই আবার নিজের লেখা চিঠিটা পড়তে শুরু করে—

প্রিয় আনা,
তোমার বেদনায় আমি নীল হয়েছি। স্বামীর কাছে তোমার যত না পাওয়া, তা পূরণে তোমার পরকীয়ার সিদ্ধান্ত আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। সমাজের চাপে নতি স্বীকার না করে তুমি স্বামীকে রেখে যে প্রেমিকের কাছে ছুটতে চেয়েছো; সেই সিদ্ধান্ততেও আমি সম্মত। সকল কিছু ফেলে এই যে তোমার মিলন বাসনা, তা তোমার ভালোবাসার গভীরতাকেই স্পষ্ট করে তোলে।

আনা তোমার সৌন্দর্যের পুজারি হয়েছি আমি। তবে তুমি নিজের ভালোবাসায় যেভাবে জীবনকে সিক্ত করতে চেয়েছো; সেই সাহসকে আমি সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করলাম।

ইতি

দূর থেকে তোমার গুণমুগ্ধ হয়ে ওঠা এক প্রেমিক
খালেদ সোহেল

চিঠির ভাঁজের ওপরে লেখা, ‘আজ মনটা ভারী হয়ে আছে। আনার দুঃখে কাতর। তাই প্রিয় বউ, প্রিয় চরিত্রকে এই চিঠি লিখলাম।’

আৎকে উঠলো খালেদ। সর্বনাশ। বউ-বিভ্রাটেই এই অবস্থা!

নিজের লেখা চিঠি পড়ে এ রকম ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেও হেসে ফেললো সে। হাসি থামছেই না খালেদের। বউকে বোঝাতে ব্যাগ থেকে লিও টলস্টয়ের লেখা ‘আনা কারেনিনা’ বইটি বের করলো সে, সাথে গতদিনের ডায়েরিটা।

বউকে বলল, ‘দেখ ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব চিঠি দিবস। এবার আমরা ঠিক করেছি যে বইয়ের চরিত্রকে যত বেশি ভালো লেগেছে; তাকে একটা করে চিঠি লিখবো। পরের ক্লাসে সেই চিঠিগুলো নিয়ে আলোচনা হবে, কার চিঠি কত মনোরম হলো। সবাই লিখছে। আমার এ চিঠিও সে কারণেই লেখা।

বউ তবু অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে। আনা কারেনিনা বইয়ের লাল প্রচ্ছদ বিদ্রোহ যেন গাঢ় করে দিচ্ছে, শান্তির বার্তা আসছে না।

এবার খালেদ প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘বইটা পড়ে ভালো লেগেছে তাই আনাকে এই চিঠি লেখা। কেবল শেষ লাইনে ‘তাই প্রিয় বই, প্রিয় চরিত্রকে এই চিঠি লিখলাম’। বাক্যটাতে ভুলে বইয়ের জায়গায় লিখে ফেলেছি ‘বউ’! ই-টা ভুল করে ‘উ’ হয়ে গেছে।

বই আর বউ বিভ্রাটের পরের অংশের ঘটনাটা আর জানা যায়নি। চিৎকার চেঁচামেচিও আর শোনা যায়নি।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

খালেদদের শোবার ঘরের বড় বাতি নিভে গিয়ে জ্বলতে দেখা গিয়েছিল নীলচে আলোর হালকা বাতিটা।

মুল লেখা

রুখসানা মিলি
রুখসানা মিলি
জনসংযোগ পেশায় কর্মরত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে লেখাপড়া করেছেন। ভ্রমণ, নারী, ডিজিটাল সচেতনতা, মানবিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের লেখালেখির সাথে যুক্ত।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Most Popular

Recent Comments

SahityaPotrika.com · WordPress Showcase ·
Casino Siteleri · Bahis Siteleri · Kumar Siteleri
Casino Sites · Betting Sites · Gambling Sites