Homeপ্রবন্ধপ্রাচীন সাহিত্যে নারী

প্রাচীন সাহিত্যে নারী

‘নর’ বা ‘নৃ’ শব্দের সঙ্গে স্ত্রী (ঈ) বা ঙীষ প্রত্যয় যোগ করে পাওয়া যায় ‘নারী’ শব্দটি। নারী শব্দের অর্থ স্ত্রীলোক বা সীমন্তিনী বা নরের ধর্ম্ম্যা। আবার প্রাচীন বিভিন্ন ব্যাকরণ শাস্ত্রে, ধর্মগ্রন্থে নারীদের সম্পর্কে বহু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের  ‘রসমঞ্জরী’ কাব্যে পাওয়া যায় পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী, হস্তিনী ভেদে নারী চতুর্বিধা। বাংলায় পত্নী অর্থেও নারী শব্দটি প্রচলিত। পৃথিবীর প্রাচীন সাহিত্য “ঋগ্বেদ”-এ- নারীদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়। বেদের সেই সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সাহিত্যে নারীদের যে বিবর্তন ঘটেছে, এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রেও নারীদের যে বিবর্তন তার মোটামুটি একটা রূপরেখা আমি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম এই প্রবন্ধে।

আমরা জানি পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদ সংহিতা। এই যুগকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা আদি বৈদিক যুগ আর পরবর্তী বৈদিক যুগ। প্রথমে আসি আদি বৈদিক যুগের কথায়। এই যুগে জ্যেষ্ঠ পুরুষই ছিল গৃহস্বামী অর্থাৎ পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তবুও নারীদের কার্যকলাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে আদি বৈদিক যুগের প্রথম পর্বে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ছিল। আর্যদের দেব মণ্ডলীর মধ্যে তখন নারীদের প্রাধান্য ছিল। ঊষা, ইলা, ভারতী, সরস্বতী, বাক ইত্যাদি, পরে ক্রমে পুরুষদের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ থেকে বোঝা যায় সমাজ ক্রমে ক্রমে পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষ প্রধান হয়ে উঠছে। বৈদিক যুগে আমরা যে নারীদের দেখি তারা ছিলেন মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তারাও পুরুষদের পাশাপাশি মন্ত্রতন্ত্র, যাগযজ্ঞ, ও বেদ পাঠের অধিকারিণী ছিলেন। কখনো কখনো তারা মন্ত্র রচনাও করতেন, অধ্যাপনা করছেন, প্রকাশ্য সভায় তর্ক যুদ্ধে অংশ নিতেন। তারা সভা-সমিতিতে অংশ নিতেন, যুদ্ধবিদ্যাতেও অনেকে দক্ষ ছিলেন। ঋগ্বেদে একাধিক যোদ্ধা নারীর উল্লেখ আছে। অপালা, বিশ্ববারা, লোপামুদ্রা প্রমুখ নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। এই যুগে কন্যা সন্তানদের অবহেলার চোখে দেখা হত না। তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগও দেওয়া হয়। নারীরা স্বয়ম্বর সভায় অংশ নিয়ে নিজেই পতি নির্বাচন করতে পারতেন। আবার কোনো কোনো নারী অবিবাহিত থেকে বিদ্যাচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করে জীবন অতিবাহিত করতেন। যে কুমারীরা বাপের বাড়িতেই বুড়ো হয়ে যেত তাদের ‘কুলপা’ কন্যা, ‘অমাজু’ বা ‘অমাজুরা’ (অমা=বাড়ি, জু-জীর্ণ হওয়া) বলা হত। সমাজে পণপ্রথা প্রচলিত ছিল। সমাজে পর্দাপ্রথা ছিল না। নীতিগত শিক্ষায় (Moral Education) নারীর স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গৃহস্থলির বাইরে তাদের অধিকার খর্ব করা হত। তারা শৈশবে ছিলেন পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন :-

“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।

রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা নস্ত্রী স্বাতন্ত্র্যর্মহতি।।”

সুতরাং পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের ভূমিকা ছিল পুরুষদের তুলনায় গৌণ।

পুরুষরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহুবিবাহ করলেও নারীদের বহু পতি গ্রহণের কোনো নিদর্শন ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না।তবে নিঃসন্তান অবস্থায় স্বামী মারা গেলে নারীরা পুনরায় বিবাহ করতে পারতেন। ঋগ্বেদে সতীদাহ প্রথার নিদর্শন পাওয়া যায়।স্বামী মারা গেলে সন্তানবতী মহিলারা মৃত জ্বলন্ত স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জন দিতেন। পনপ্রথা প্রচলিত থাকলেও সাধারণত সে পণ পেতেন কণ্যার পিতা।তবে কন্যা প্রতিবন্ধী হলে কন্যার পিতা ‘বরপণ’ দিতে বাধ্য হতেন।

কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থার অবনতি হয় অনেকটাই। নারীরা হয়ে পড়ে ব্রাত্য, অবহেলিত। সংসার সামলানো, পারিবারিক কাজকর্ম, সন্তানের জন্ম দেওয়া আর পুরুষের যৌন লালসা মেটানো — এই ছিল নারীর পরিসর। তারা ছিল কূপমণ্ডুক। কুয়োতে ব্যাঙ পড়লে সে যেমন সেই কুয়োকেই তার পৃথিবী ভাবে, তেমনি পারিবারিক আবেষ্টনীর মধ্যেই নারীরা সীমাবদ্ধ ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে আমরা পাই

“খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার

এই তোমাদের পৃথিবী,

এর বাইরে জগৎ আছে

তোমরা জানো না,

তোমরা নিজেও জানো না।”

এ যুগের বিভিন্ন সাহিত্যে নারীদের সম্পর্কে প্রচুর নিন্দাবাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই যুগেই নারীরা উপনয়নের অধিকার হারান, হারান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাজে যোগদানের অধিকার। অধিকাংশ পিতা মাতা কন্যার জন্মকে সানন্দে মেনে নিতেন না। তারা মনে করতেন কন্যা পরিবারে দুঃখ নিয়ে আসে আর পুত্র পরিবারকে রক্ষা করে। তারা স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। অসবর্ণ বিবাহের (অনুলোম ও প্রতিলোম) ফলে সমাজে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। এ ধরনের বিবাহকে সমাজ স্বীকৃতি দিত না। অথর্ব বেদে কন্যার জন্মকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আদি বৈদিক যুগে নারী ছিল সহধর্মিনী, আর পরবর্তী বৈদিক যুগে নারী হয়ে ওঠে ‘ভার্যা’ অর্থাৎ ‘ভরণীয়া’ বা যাকে ভরণ করতে হয়। এজন্য তার স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই। পরবর্তী বৈদিক যুগে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রথা, নারীদের একাধিক স্বামীর অস্তিত্বও দেখা দেয়, আবার বিধবাবিবাহ, পণপ্রথা, নারীদের বারাঙ্গনাবৃত্তিরও অস্তিত্ব দেখা যায়। তবে নারীরা গৃহে কিন্তু ছিলেন সর্বেসর্বা। এতদ্ সত্ত্বেও অনেক নারী এযুগেও উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে ছিলেন না। তারা পুরুষদেরও টেক্কা দিয়েছিলেন রীতিমত। গার্গী ও মৈত্রেয়ী ছিলেন এযুগের কৃতী দুজন নারী। সুতরাং খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে প্রাক-বৈদিক যুগের নারীদের একটা বিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। এ বিবর্তন মূলত যুগের পরিবর্তনে এসেছে। যেহেতু সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ, দর্পণে যেমন নিজের মুখ দেখা যায়, তেমনি সমকালীন সমাজকে চেনা যায় সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। উভয় বৈদিক যুগের নারীদের অবস্থা দেখে তৎকালীন সমাজের সামাজিক অবস্থার বিবর্তনের ছবি ধরা পড়ে। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে লেখা হয়েছে —

“নারীং ন হৃদয়েন প্রার্থয়েৎ” অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে নারীকে প্রার্থনা করা উচিত নয় অথচ নারীকে যথেষ্ট ভাবে ভোগ করতে কোনো বাধা ছিল না। তৈত্তরীয় উপনিষদেও নারীকে ‘অভিশাপ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ নারী শুধুমাত্র সম্ভোগের সামগ্রী — এই নিচ, হীন, জঘন্য প্রথা ছিল তখনকার সমাজে। নারীকে পণ্য হিসাবে মনে করা হত। তবে এসবের মাঝেও নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন স্মৃতিশাস্ত্রকার মনু। তাঁর গ্রন্থের নাম ‘মনুসংহিতা’। তিনি ছিলেন ঋগ্বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। তাঁর সময়কাল আনুমানিক ২০০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ। তিনি তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের ৫৬ নং শ্লোকে বলেছেন-

“যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রম্যন্তে তত্র দেবতাঃ।

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।” 

অর্থাৎ যে কূলে নারীগণের সমুচিত সমাদর করা হয় অর্থাৎ নারীদের পূজা করা হয়, সেখানেই দেবতা প্রসন্ন হন অথবা দেবতা বিরাজ করেন। আর যে পরিবারে স্ত্রী লোকের পূজা নেই, সম্মান নেই, সেই পরিবারে যজ্ঞাদি,ক্রিয়াকর্ম সবই ব্যর্থ হয়ে যায়। আবার তৃতীয় অধ্যায়েরই ৫৭ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে –

“শোচন্তি জামায়োযত্র বিনশ্যস্ত্যাশু তৎকুলম্।

ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধিসর্ব্বদা।।” 

অর্থাৎ যে স্কুলে ভগিনী ও গৃহস্থের স্ত্রী পুরুষদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতি শীঘ্রই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আর যে বংশে স্ত্রীলোকরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ নিশ্চিতভাবেই সমৃদ্ধি লাভ করে। মনু তাঁর গ্রন্থে নারীদের সর্বদা সুখী রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অনেকে মনুকে নারী বিদ্বেষী বলে থাকেন। তারা উপরের শ্লোকগুলি বিচার করে দেখবেন। উপরের বিষয়গুলো মোটেও লোক দেখানো নয়। নারীকে প্রকৃতই মাতৃরূপে, কন্যারূপে, স্ত্রীরূপে, ভগিনীরূপে এবং সকল কল্যাণের উৎস রূপে মনু উল্লেখ করেছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্ত্রীরাই সকল সুখের মূল। কারণ ধর্মপালন, পরিবার পরিজনদের পরিচর্যা,সন্তান উৎপাদন, সন্তান পালন, দাম্পত্য জীবনে শান্তি বয়ে নিয়ে আসা — এসবই নারীদের দ্বারাই সম্ভব। সুতরাং ঋষি মনু নারীদের যথাযোগ্য আসনে বসিয়েছিলেন। সেই সময় সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থায় অবহেলিত, ব্রাত্য ও লাঞ্ছিত নারীদের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই হয়ত মনুকে কলম ধরতে হয়েছিল। নারীদের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই হয়ত মনুকে এই স্তোত্রগুলি লিখতে হয়েছিল। নারী এ সময় ছিল পর্দানসীন, অসূর্যস্পর্শ্যা। তারা যেন সূর্যের আলো না দেখতে পারে — তার জন্য ছিল ঢালাও ব্যবস্থা। সমাজ ব্যবস্থার নিয়মের এই ঘেরাটোপে নারীর দিন কাটত। তবে নারীরা ছিল পুরুষদের বশীভূত। পুরুষতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে তাদের পিষ্ট হতে হয়েছে। সে যুগে নারী অপহরণের ঘটনাও ঘটত আকছার। তাই নারী অপহরকদের শান্তির বিধানও মনু তাঁর ‘মনুসংহিতায়’ উল্লেখ করেছিলেন। সব মিলিয়ে সে যুগে নারীদের অবস্থা দোষে গুণে একটা সন্তোষজনক অবস্থায় ছিল। তবে মনু নারী স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছেন। স্ত্রীলোক বালিকা, যুবতী কিম্বা বৃদ্ধাই হোক সে গৃহমধ্যে থেকে কোনো কাজ স্বামী বা অন্য কোনো পুরুষের বিনা অনুমতিতে করতে পারবে না। ‘মনুসংহিতা’-র ৫ অধ্যায়ের  ৫ অধ্যায়ের ১৪৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে —

“বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি ঘোষিতা।

ন স্বাতন্ত্র্যেণ কর্তব্যাং কিঞ্চিৎ কার্যং গৃহষবপি।।”

উভয় বৈদিক যুগের তুলনামূলক বিচারে নারীদের এই বিবর্তনের ছবি ধরা পড়ে মূলত তাদের সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় জীবন, অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে।

তথ্যসূত্র :

১. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।

২. ‘প্রাচীন ভারত’, সুকুমারী ভট্টাচার্য।

৩. ‘মনুসংহিতা’, ৯:৩

৪. ‘মনুসংহিতা’, ৩/৫৬

৫. ‘মনুসংহিতা’, ৩/৫৭

৬. ‘মনুসংহিতা’, ৫/১৪৭

পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Most Popular

Recent Comments

SahityaPotrika.com · WordPress Showcase ·
Casino Siteleri · Bahis Siteleri · Kumar Siteleri
Casino Sites · Betting Sites · Gambling Sites