লেখা:লাবণী মণ্ডল
আশির দশকে বাংলা কথাসাহিত্যে আবির্ভূত নাসরীন জাহান প্রথম উপন্যাস উড়ুক্কু দিয়ে পাঠকমহলে আলোচিত হন এবং ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। পরে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পান। ২০২৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ পালকের চিহ্নগুলো পাঠককে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
স্মৃতি ও ব্যক্তিজীবন
বইটি নিছক স্মৃতিচারণা নয়; এটি ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণা, প্রেম, দাম্পত্য, মৃত্যু ও সাহিত্যচর্চার টানাপোড়েনের দলিল। বইয়ের নাম এসেছে হঠাৎ—কবি আশরাফ আহমদ প্রস্তাব করেছিলেন পালকের চিহ্নগুলো, উড়ে যাওয়া পাখির ছায়ার মতো অনুভূতি প্রকাশের জন্য।
শৈশব থেকে কৈশোর, প্রাপ্তবয়স্ক জীবন—সবকিছুই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। শৈশবে লাঞ্ছিত হওয়া, প্রথম প্রেম, দাম্পত্যের ঝড়—সবই অকপটে। যেমন লিখেছেন, ‘আমার প্রথম প্রেম ক্লাস থ্রিতে থাকতেই…এরপর গভীর প্রেম এসেছে জীবনে, ভেতরে বিষের বালি নিয়ে উল্টো দিকে আমার হাঁটার কারণে সেসব প্রেম পরিণতি পায়নি।’
সংসার ও সাহিত্যচর্চা
বিয়ে, সংসার আর লেখালেখি—তিনটি পথ যেন একসঙ্গে পাড়ি দিয়ে চলেছেন তিনি। সংসারের ভিড়ে বড় ভাবির দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে, তবু কলম ছেড়ে বসে থাকেননি। রাত জেগে লিখেছেন, দিনের ফাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন, চাকরিও করেছেন। কিন্তু যেখানেই ছিলেন, মন সব সময় টানত এক জায়গায়—লেখার টেবিলে—যেখানে শব্দেরা তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকত।
নাসরীন জাহান শুধু ব্যক্তিগত আখ্যানই নয়, সমাজ, সাহিত্য এবং নারীচেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। নারীজীবনের সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি দেখিয়েছেন, স্বাধীনতা ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক আন্দোলনের অংশ।
সাহিত্য-আড্ডা ও বন্ধুত্ব
লেখক তুলে ধরেছেন সাহিত্য-আড্ডা, ভ্রমণ, বন্ধুত্ব ও সহযাত্রার কাহিনি। সহলেখক নজরুল, সেরীন ফেরদৌস বা স্বপ্নবানের মতো চরিত্রগুলোর মাধ্যমে গড়ে উঠেছে প্রেরণাদায়ক পরিবেশ। তিনি নিজেকেও অকপটে সমালোচনা করেছেন; একজন লেখকের স্বচ্ছ দৃষ্টি পাঠকের জন্য শিক্ষণীয়।
পুরস্কার প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘পুরস্কার কখনো লেখকের চেয়ে বড় হতে পারে না। লেখার দায় একেবারেই ব্যক্তিগত। লেখক টেবিলে একা।’
জীবন ও মানবিক দৃষ্টি
এ গ্রন্থে জীবনের নাটকীয়তা ও আকস্মিকতা স্থান পেয়েছে। পরিবারে আত্মহত্যার মর্মান্তিক ঘটনা, মৃত্যুচিন্তার গভীর উপলব্ধি—এগুলো লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে। জীবনের দর্শন, সংগ্রাম ও মানবিক মূল্যবোধ বইটিকে ব্যক্তিগত পরিসর থেকে তুলে এনেছে সমাজ ও সাহিত্যের বৃহত্তর পরিসরে।
ভাষা ও শৈল্পিকতা
ত্রুটি বলতে একটিই—বানান ভুল ও সমাসবিচ্ছিন্নতা, যা পাঠের গতি কিছুটা ব্যাহত করে। তবু বিষয়বস্তু ও শৈল্পিক উপস্থাপনা সেই সীমাবদ্ধতাকে আড়াল করে। শেষ অংশে লেখক জীবনের দ্রুত অতিক্রম, স্মৃতির ঘনত্ব ও আত্মজিজ্ঞাসার আলোকে পাঠককে অভিজ্ঞতার ভেতরে টেনে নেন। প্রতিটি বাক্যে জীবন ও সাহিত্য জড়িয়ে যায়। তিনি শুধু নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেননি; পাঠককেও ভাবতে বাধ্য করেছেন—জীবন ও মৃত্যুর সম্পর্ক, স্থায়িত্ব ও মানুষের অবলীলার প্রতিফলন নিয়ে। সরল অথচ গভীর ভাষা, প্রাঞ্জল বাক্য ও ছন্দ পাঠককে প্রবহমান অনুভূতি দেয়। সহজ কথার ভেতর তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন শৈশবের উচ্ছ্বাস, প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বাস্তবতা ও সাহিত্যচর্চার দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে পালকের চিহ্নগুলো কেবল আত্মজীবনী নয়—এটি স্মৃতি, জীবন ও সাহিত্যের বুননে রচিত এক অনন্য দলিল।
পালকের চিহ্নগুলো
নাসরীন জাহান
প্রকাশক: বেঙ্গল বুকস
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: আজহার ফরহাদ
পৃষ্ঠা: ২৮৮
মূল্য: ৪৯৬


                                    