Homeছোটগল্পমস্ত হাঙর পেটে

মস্ত হাঙর পেটে

পাহাড়ের গা বেয়ে শেষ বিকেলের সূর্যটা তখন ধীরে ধীরে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেছে। চারপাশে মেঘ আর কুয়াশা যেন একই রকম রঙ ধরেছে। খোলা আকাশের নীচে হিমশীতল হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পাঁজরের হাড়ে হাড়ে। বাহারি কৃত্রিম আলোর ছটা আর তাতে লাল,নীল,সাদা ছাড়াও নানা রঙে ভরে উঠছে পুরো স্টেশন। রাত বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত। ঠান্ডা বাতাসটা ক্রমাগতভাবেই এসে গায়ে লাগছে।

চোখ কচলাতে কচলাতে এদিক সেদিক দেখে কোনকিছু ঠাওর করতেও পারলাম না হঠাৎ কোথায় দাঁড়িয়ে গেছি। আঁটোসাটো পোশাকে আবৃত করা নিজেকে চাঁদ ভ্রমণের নভোচারী মনে হচ্ছে। হঠাৎ বিরতি ঘুমের বিভ্রাট ঘটালো বৈকি। রেলগাড়ীর কামরা তখন শুনশান নীরবতা বন্দি। অগত্যা একজনকে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলেন ” রেস্ট লন রেস্ট”। পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলেন, অপরদিক থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে। এর বেশি কিছু বলার আগ্রহ হয়তো ছিলনা। তাই হাই তুলতে তুলতে বিদেয় হলেন পূর্বের আগুন্তক মহোদয়। আশপাশে কোন সাইনবোর্ড নেই, অঞ্চলটি চিনবার বিশেষ কোন চিহ্নও নেই। না-ই থাকুক জেনে খুব একটা লাভও নেই। যাত্রা দীর্ঘ হতে যাচ্ছে মনে মনে এতটুকু চিন্তা করেই আপাতত চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।

দিবসের কোলাহল ফুরিয়ে রাত্রের শেষভাগ। কুয়াশাজড়ানো প্রকৃতি এক শান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে নিঃশব্দে। মায়াকান্নার মত টুপটাপ শব্দে ঘন কুয়াশা বৃষ্টির মত হয়ে ঝড়ে পড়ছে। নির্জীব গাছের পাতাগুলোয় ধুলো আর শিশিরের মিশ্রণে নতুন রঙ এনে দিয়েছে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এ শীতই যেন তুষারপাতের চেয়ে ঢের। ঠান্ডায় জবুথবু মানুষের জমে যাওয়ার উপক্রম।
এ শীতার্ত রাতের যাত্রী হয়ে একটা দীর্ঘ রজনী যেন সময়ের ফ্রেমে আটকে আছে স্টেশন দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটির মত।

ফেরিওয়ালাগুলো বেচাকেনার শেষে কনকনে ঠান্ডায় জানালায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সারাদিনের ক্লান্তি লাঘবের জন্য। গায়ে পুরোনো পোশাক, কানে একটা ময়লা মাফলার।
পরিবারের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেয়ার এ নিরন্তর সংগ্রাম। থেমে না থাকা ক্লান্তিহীন দিনরাত্রি। লোকগুলোকে দেখে তন্দ্রাঘোরে চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল পুরনো দিনগুলো, আমার উত্তরহীন প্রশ্নগুলো!

তখন এলাকার কাঁচা রাস্তা দিয়ে গরু আর মহিষের গাড়ি চলতো। শীতে ধুলায় ধূসর হতো আশপাশ। লোকালয়ের সূর্য ছুটিতে যেত কয়েকদিনের জন্য। নিঃশ্বাসে আগুনের মত ধোঁয়া বের হতো সবার মুখ থেকে। পকটের কলম টাকে বিড়ি হিসেবে ফুঁকতো তারপর ধোঁয়া ছাড়তে সমবয়সী ছেলেরা। যেখানে সেখানে কাগজ পলিথিন বা খড়ের পালা থেকে আঁটি চুরি করে আগুন জ্বালিয়ে শরীরকে উত্তাপ দেয়ার চেষ্টা করতো হালকা থেকে মাঝবয়েসী সবাই। পেটের তাগিদে হাল জোয়াল নিয়ে বের হওয়া কিষাণী, দিনমজুর লোকজন।

মুয়াজ্জিনের আযান শুনে সন্ধ্যা আসতো লোকালয়ে, সাধ্যমত পোশাক পরে লোকজন বের হয়ে আসতো মোড়ে মোড়ে। গলির রাস্তার মোড়ের মুদি দোকানটা, চা পান সিগারেটের একটা দুই বেঞ্চির টং দোকান, দোকানের মধ্যে শীতের চাদর লেপ্টে বসে খুক খুক কাশত হাশিম কাকা। কাশি জরা ব্যাধি নিয়েও কাকা তার দোকান চালিয়ে যেত। এ বয়সে কেন এমন কষ্ট করে কেটলী উঁচিয়ে কাপে চা ঢালতো বুঝতে পারতাম না। চায়ের সঙ্গে কোনদিন লেবু থাকতো তো আদা থাকতো না, হুটহাট বন্ধ হয়ে যেত চায়ের চুলাটা অনিশ্চয়তার জীবনের মতই কাকার চায়ের চুলা। সন্ধ্যায় কুপি বাতির আলো যতক্ষণ জ্বলে ততক্ষণেই চলে কেনাবেচার আয়োজন, রাজনৈতিক আলাপ।

দোকানটার পর যে ফাঁকা জায়গটা সেখানে পাটের ব্যাগ গুছিয়ে বসতো একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুক। সারাদিন তসবী জপে, সূরা বলে ভিক্ষা করত, দিনশেষে আনা পয়সা বা আধুলি বার কয়েক গুণে গুণে দোকান থেকে টাকায় বদলী করে নিত। আধাকেজি চাল, নুন, আটা,তেল। সংসারের সঙ্গী পরপারে পাড়ি জমিয়েছে বৃদ্ধ লোকটাকে একা রেখেই। হাতে বাঁশের লাঠি ভর করে এগিয়ে যেত বয়সের ভারে নতজানু দেহটা। নিতান্তই জীবন আছে বলেই তার প্রতিদিনের যুদ্ধ। আশেপাশে এমন বৃদ্ধ বয়সের ভিক্ষুককে দেখে আমার ভেতর হুঁ হুঁ করে উঠতো।

অনেক বৃষ্টি হলে ঐ যে ঝালমুড়ি বিক্রি করা বয়স্ক লোকটা। উনাকে কাকা বলেই ডাকতাম। মনে হতো আজ তো বেচাবিক্রি হলো না তাহলে উনার পরিবার আজকে কি খাবে? জীবনের পড়ন্ত বেলাতে এসেও কেন এমন রোজকার এমন দিনযাপন! না কিছুই বুঝতে পারতাম না।

ছোট্ট বাক্সে করে কয়েক স্তরের পলিথিন আর বরফ দিয়ে কুলফি মালাই বিক্রি করতো আমার বয়সী ছেলেটা! মাঝে মাঝেই মনে হতো আমাদের স্কুলের লম্বা ছুটির দিনগুলোয়! আচ্ছা! কিভাবে কেমন করে চলবে ওদের দিন!
ঐ যে ননি পাগলটা! মানুষকে দেখা মাত্রই বলে উঠতো আমি সবাইকে কোর্টে চালান করে দিব। আমি দারোগা। কিন্তু খিদে পেলে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকতো শিশুর মত করে!

আমাদের বাড়ির পিছন দিকে রাতজাগা কুকুরগুলো হঠাৎ কান্না করলে মায়ের কাছে জানতে চাইতাম! আচ্ছা মা! ওরা কি খিদেয় কান্নাকাটি করছে! আচ্ছা মা খিদে পেলে কান্না আসে কেন! আমার অবুঝ মনের সরল প্রশ্নে বিপরীতে মা শুধু বলতো বড় হ তখন বুঝবি!

আমার মনে হতো খিদের মানে পেটের ভেতর ভাঁজে ভাঁজে একটা মস্ত হাঙর থাকে সেটা তাড়া করে বেড়ায় কিন্তু তাকে দেখা যায় না! আবার এ-ও মনে হতো! খিদে বোধহয় মস্ত বড় কোন অসুখ! একবারে কোনদিন সারে না! বার বার ফিরে আসে।
ক্ষুধায় আক্রান্ত রোগের নিকট পৃথিবীর সমস্ত অসুখই বড় ঠুনকো। এত এত আবিস্কার আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের মাঝেও ক্ষুধা সারানোর ঔষধ আজও অচেনা, অজানাই থেকে গেল!! আর চোখের ছলছল করা জল!
ঐ যে দুনয়নের টলমল করা ছল ছল আঁখি নিজ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে ক্ষুধাটাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য