ঠিকানার সংকটে
পথভুলে যে রাস্তায় দীর্ঘসময় হেঁটে চললাম তার শেষপর্যন্ত গিয়ে শুনলাম ডাকঘরটি নেই। একখানা পুরাতন ঘরের বৈঠকে স্থান হয়েছিল এ ডাকঘরের। তখন আমাদের সোনালী সব দিন। আনাড়ি লেখনীর কলমে এলোমেলো সব ভাষা, শব্দচয়ন। নিতান্তই নিজের প্রয়োজনে ডাকপিয়নের সাথে খাতির জমিয়ে তোলা। হাতে হলুদ খাম নিয়ে ছুটে চলা দিনগুলো।
পথিমধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসার খাতিরে জানতে পারলাম ডাকপিয়ন অবসরে গিয়েছেন বহুবছর। এ ডাকের ঠিকানাটা এখন কেবলই সরকারে খাতায় লিপিবদ্ধ এর কার্যকরীতা নেই বটে।
যখন একে ওকে জানতে চাইলাম তাদের অনেকের কাছেই ডাকঘর শব্দটিই যেন নতুন। বলতে গেলে পরিচয়ের ঘোর সংকট।
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলেন রুদ্র। প্রিয় মানুষকে দেবার মত একটা ঠিকানাই আজ ডাকঘরের মত ঘোর সংকটে। যার ঠিকানা নেই বিশাল আকাশটায় তার ঠিকানা। রুদ্রের অনুভবের পৃথিবীতে আকাশ ব্যতীত আর কোন ঠিকানাই উপযুক্ত মনে হয়নি।
পত্রের পাতায় পাতায় জীবনের সমস্ত আবেগ নিংড়ানো যায়, ছল ছল অশ্রুসিক্ত নয়নের দুফোঁটা জল গড়িয়ে মিশে যায় দোয়াতের রঙে।
ঠেলাগাড়ীর মত যে জীবন তাকে রোজ ধাক্কায় এগিয়ে নিতে হয়। সমাজের আড়চোখ, প্রকাশ্যের লজ্জা, গোপনে লুকিয়ে রাখা অনুভূতি বৃষ্টির মত ঝরে পড়ে পত্রের অক্ষরমাত্রায়।
সম্ভাবনাময় জীবন সংকটের খাবি খেতে খেতে কতটা দূরুহতার জালে জড়িয়ে যায় তা বোধগম্যও নয়। তবু প্রেমিকের জীবন জুড়ে একখানা পত্র সমস্ত বেদনার ব্যথানাশকের মত অমৃত।
বনলতার কাছে দুদন্ড শান্তির নিঃশ্বাস চেয়ে জীবনানন্দ লিখে গেছেন শত শত পত্রকাব্য। কসরতের জীবন নিংড়ে দুফোঁটা ঘামের মত সুখ অপ্রাপ্তি আর তিক্ততার জীবনের কাছে স্বর্গেপ্রাপ্তির মত। পত্রের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে হৃদয়ের গোপন করিডোরে নিরন্তর আনাগোনা, অলিখিত সব চাওয়া, আনন্দ বেদনার সীমাহীন চাহিদা, থাকে মোহ, অভিমান আর দীর্ঘশ্বাস। অনিশ্চয়তার ডামাডোল, বিচ্ছেদের অনল।
বুকের ভেতর খই ফোটার মত কতক শব্দ বাক্য প্লাবনের মত ভরিয়ে ফেলে পত্রের এপাতা ওপাতা শেষে অনেকটাই যেন বলা না হওয়া অনুক্ত আর অব্যক্ততার আক্ষেপ।
কথা জমতে জমতে সুউচ্চ পাহাড়ের মত বিশালকায় ঐ আকাশ ছুঁয়ে ফেলে, হলুদ খামের চিঠি জমে বাক্স ভরে যায় ডাকপিয়নের অসুস্থতায়। খাকি বস্তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা দুজন মানুষের কতক আকুতি, মিলন বিরহের শতকাব্য। অপেক্ষার দামে এ পৃথিবী কেনা যায় অথচ তার মূল্যমান সমাজের চোখে নিতান্তই শূন্য।
সভ্যতার নানান নতুনত্ব ঘোর সংকটে ফেলেছে পৃথিবীর অনেক কিছুকেই। প্রেমিক সমাজের চোখে কোন পরিচয়ের নাম নয়। বেখেয়ালে বদনাম ছড়ানোর নিয়ামক কেবল।
ঠিকানাহীন এ শহরে রুদ্রের ঠিকানাটায় আমার আজকের ঠিকানা। আদরের পোষা পায়রার ঘুঙুরে বেঁধে তুমি একখানা চিঠি দিও আকাশের ঠিকানায়।
ঠিকানার সংকটে~