Homeছোটগল্পএকটা গল্পের খোঁজে বহুদূরের পথ

একটা গল্পের খোঁজে বহুদূরের পথ

একটা গল্পের খোঁজে বহুদূরের পথ, পা মাঢ়িয়ে, হাঁটাপথ যেন ক্রমে দূরদূরান্তে পিছিয়ে গেল। ভোরের ঘন কুয়াশা তখনও কাটেনি। সূর্যটা সকালের শিশির মেখে মিটমিট করে দেখা দিয়েছে পুব গগণে। তার আভার সাথে জড়িয়ে গেছে কুয়াশারা। তেজহীন রশ্নি, কুয়াশার তোপ ছেদ করে আলো এসে ঠিকমতো পৌছুয়নি এ মাঠ- ঘাট, পথ-প্রান্তরে।

মেঘাছন্ন দিনে কু্য়াশার দাপট, সারাদিবস জুড়েই যেন সন্ধ্যার আবহ। স্মৃতির আঙিনায় আজকের ফেরা সেই চিরায়ত বাংলায়। জীবনের সমস্ত আয়োজন যেখানে কর্মমুখরতায় বিলীয়মান হয়ে যায়নি, হারিয়ে যায়নি সোনালী শৈশব, দূরন্ত কৈশোর।
পাঠশালার বিরতির একটা আমেজ, মৌ মৌ করে মৌমাছির মত গুঞ্জন তুলে যায়।
চোখের আগায় যতদুর দৃষ্টি তার সবটা জুড়েই সরিষার ক্ষেত, হলুদের প্লাবন ডাকা ভোর। হলুদ সমারোহের মাথার ওপর একখানা নীলাকাশ। ক্ষীণ আলোয় রেখার মত মিলিয়ে গেছে ঐযে খানিক দূরেই।

আলপথে একদল কিশোরীর ঝাঁক, সকাল বেলার শিশিরে সিক্ত ঘাস আর শাক তুলতে এসেছে। ভেজা হাতে ঘাসের সাথে সাথে লুকিয়ে কটা শাক তুলে ঝুঁড়িতে রাখা, দুপুর বেলায় মায়ের হাতে রান্না সে কচি শাক। গায়ে জরাজীর্ণ পোশাক, জুবুথুবু শীতার্ত শরীর তবু এক উপচে পড়া সুখ।
একটু দূরে স্যালো মেশিনের আওয়াজ, জমিতে সেচের ঠান্ডা জল ছন্দের মত ভিজিয়ে যাচ্ছে পুরো জমিন।
নির্জনতার কাছে নিজেদের জিম্মি করেছে বড় বড় বৃক্ষরাজি। শুনশান নীরবতা, মাঝে মাঝে খানিক হিমেল সমীরণে মৃদু দোল খাওয়া পাতাগুলো জেঁকে বসা ঠান্ডাকে আরো উস্কে দিয়ে যাচ্ছে।

কারো অপেক্ষায় থমকে গেছে দিন। নয়নাভিরাম এ সবুজের ঘ্রানে এক স্বতন্ত্র অনূভুতি আছে, তার সুখে বুকের ভেতর আন্দোলিত হয়।

বেলা গড়াতে জনশূন্য মাঠঘাট। ঘড়িতে সময় বলে দ্বিপ্রহর এসেছে এখন। কিন্তু প্রকৃতির গায়ে গায়ে লেপ্টে আছে সকাল। এ নিঃশব্দ নিঃসঙ্গ মাঠে বসে আনমনা এক পথিক কিংবা মুসাফির যেন পৃথিবী পরিভ্রমণে এসে আটকা পড়েছে এক মায়ার কাছে।
মাঝে মাঝে কতক পাগলামী ভর করছে মাথায়। হুটহাট করে এ হলুদরঙের জলোচ্ছ্বাসে গা এলিয়ে লুকিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। ছোটবেলার সে লুকোচুরি খেলার মত। আড়ালের সূর্যটার মত ঝোপঝাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার মনোবাসনা।

খানিক পথ পেরুলোয় শান্ত দীঘি। সকাল সকাল নিজের আহারের বন্দোবস্ত করতে এসেছে কয়েকটা মাছরাঙা, ঝিলের জল থেকে গরম জলের বাস্পের মত ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে, বৃদ্ধের তামুকের টানের মত।
এ শান্ত দীঘির এমন নীরবতা মনে মনে ডেকে যাচ্ছে শতত ঝাঁপ দেয়ার জন্য, কৈশোরে সে দামাল বিদ্রোহীর মত সকল বাঁধা উপেক্ষা করে যেন ডুবসাঁতারে হারিয়ে যায় ঐ ত্রিসীমানা পেরিয়ে।
চোখ ফেরালে দূরের গ্রামের বাড়িঘর গুলোয় আমার ঠিকানা। ঐ যে বাবুই পাখির বুননে ছোট ছোট বসতি, ছোট ছোট আঁকাবাঁকা পথ, কাঁচা রাস্তার ধুলো, কিষাণীর অগ্রহায়ণের সোনালী ধান গোলায় তুলবার ব্যস্ততার দিনরাত্রি, গাছের শুকনো পাতা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে মাথায় নিয়ে ছুটে যাওয়া ছেলেমেয়েদের দল। ঝিলের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া দু’একটা ডাহুক পাখি।

কতগুলো জীবনকে ঘিরে প্রকৃতির এ পসরা, এ কর্মযজ্ঞ, অর্থের অনার্থতা। কৃত্রিমতার সব বাঁধন ছেদ করে এক স্বাতন্ত্র্যতার সুস্পষ্ট অবয়ব। আমার ফিরবার তাড়া নেই। গল্পের লোভে লোভে পৃথিবী পরিভ্রমণের এ যে নিরন্তর চালচিত্র, একজোড়া পিপাসিত চোখ । জীবনের কাছে আর ফিরবার ইচ্ছে নেই। আমার নাম দরকার নেই, যশ খ্যাতি দরকার নেই। জগত সংসার ভুলবার মত এমন আর কি-ই বা আছে! এখানে শহুরে যন্ত্রণার ক্ষত নেই, নির্মল বায়ুর মাঝে যে নিস্তব্ধতা লুকিয়ে আছে তা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত ব্যস্ততাকে হাতছানি দিয়ে বিদায় বলা যায়। একটা গল্পের শুরু থেকে শেষ হওয়ার আগেই একটা জীবন বড়ই তুচ্ছ, বড্ড ক্ষণিকের।

একটা গল্পের লোভে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য