দখিনা জানালা
মো শাহজালাল
আজ রাফির বাবা মা খুব আনন্দিত। আগামীকাল রাফির জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।মেডিকেলে তরুণ শিক্ষার্থী হিসেবে বহুল প্রতীক্ষিত জীবন শুরু করবে সে। রাফি এবছর মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে মানসিক চিকিৎসায় পড়াশোনা করার জন্য।
রাফি নিজের শয়ন কক্ষে গভির ধ্যানে মগ্ন এমন সময় তার মা এক গ্লাস দুধ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। রাফি কী করছিস বাবা তার মা প্রশ্ন করে।কিছু না মা উত্তর দেয় রাফি। দুধ টুকু খেয়ে নে বাবা,আদর মাখা মায়ের এমন আবদারে রাফি এক নিশ্বাসে দুধ টুকু শেষ করে।
কিছুক্ষণ পর তার বাবা রাফি রাফি বলে ডাকতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাবার সাথে দেখা করার জন্য ড্রইং রুমে চলে আসে।
বাব ও ছেলের ভিতরে মিষ্টি আদর মাখা কথপোকথনে প্রকৃতি যেন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। রাফির বাবার ইচ্ছে রাফি মস্ত বড় চিকিৎসক হয়ে দেশ ও দশের সেবা করবে।কথা গুলো ভাবতে গিয়ে তাঁর চোখে পানি এসে যায়।
দিন শেষে রাত নামে, রাফি তাঁর আরেক বন্ধু অভিকে ফোন করে এই অভি রাফির সবচেয়ে প্রিয় ও কাছের বন্ধু। দু বন্ধুর ভিতরে অনেক মধুর সম্পর্ক। অভি মেডিকেল কলেজে চান্স পায়নি। সে এক পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে। যাই হোক রাতের খাবার শেষে রাফি যখন ঘুমাতে যাবে তখন হঠাৎই খেয়াল করে বাহিরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে বাহিরে এসে দেখে টুপ টাপ বৃষ্টির সুরে প্রকৃতি যেন সুরেলা আবেশ তৈরি করেছে। বৃষ্টির গন্ধে চারিদিকে সুবাসিত।
অবশেষে সে বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়।
সকালের স্নীগ্ধ আলোর ঝলকানিতে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে সে।এরপর মেডিক্যাল কলেজের পথে হাঁটতে শুরু করে দেয়।
কলেজে পৌছিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে সে দেখতে পায় প্রায় তিরিশ জনের মতো স্টুডেন্ট ক্লাসে বসে আছে সবাই অচেনা। এর ভিতর সাত আট জন মেয়ে শিক্ষার্থী।
ক্লাসে প্রবেশ করলেন একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। ইনি ডক্টর আদিত্য। আজ এনার কাছেই মেডিক্যাল কলেজের প্রথম পাঠটা নিতে হবে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনার দিকে।
ডক্টর আদিত্য সবাই কে আপন আপন পরিচয়, ইচ্ছে, সখ,কী হতে চায় বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে।এমনি এক সুন্দর আলোচনার মধ্যে দিয়ে শ্রেণিকার্যক্রম চলতে থাকে।
প্রথম দিনটা ভালোই লাগলো রাফির কাছে। অনেক নতুন মুখ, নতুনভাবে সব কিছু শুরু, নতুন পরিবেশের আলো বাতাস, গাছ পালা, পাখিদের কলরবমূখর উপস্থিতি সব কিছুই রাফিকে আকৃষ্ট করে,বিমোহিত করে তোলে।
পরের দিন আবারও ক্লাস শুরু। রাফির কয়েকজনের সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় হয়েছে এরা হলো কানন কবির শিপন। ৷ আদিত্য স্যার অনেক হাস্যজ্বল বন্ধুত্ব সুলভ একজন শিক্ষক,
সহজে সবার মন জয় করতে সক্ষম তিনি। সবার প্রিয় ড: আদিত্য স্যার। ক্লাস, পড়াশোনা, নোট সংগ্রহ ইত্যাদি নিয়ে রাফি ব্যাস্ত। অন্য কোন দিকে তাঁর খেয়াল নেই। ক্লাস টেস্ট হয়েছিল কয়েকটি সেগুলো তে রাফি খুব ভালো করেছে।
দিনে, দিনে, মাস পেরিয়ে এক বছরে পদার্পণ করলো তাঁর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা জীবন।সামনে তাদের একটা কী জানি গবেষণা মুলক টেস্ট আছে। এটা নিয়েই সবাই ব্যস্ত। গবেষণা মুলক টেস্ট বলে কথা।
ড: আদিত্য স্যার ক্লাসে প্রবেশ করে বললেন, প্রায় এক বছর তোমাদের ক্লাস হলো।সামনে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর গবেষণা মুলক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।তবে সেটা গতানুগতিক ধারার বাহিরে।এ গবেষণা ক্লাস টেস্টের মাধ্যমে হবে না, মাঠ পর্যায়ে কোন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যাক্তিকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে। গবেষণা লব্ধ শিখন কাজে লাগিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিতে হবে।
রাফি খুবই চিন্তিত কোথায় পাবে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ, কেমন করেই বা বাড়ির বাহিরে গিয়ে গবেষণা করবে। সমস্ত সমস্যাগুলো তাকে অস্হির করে তুললো। এমন সময় অভির কথা মনে হলো, সেই পারবে রাফিকে সাহায্য করতে। সমস্ত কথা অভিকে জানালো রাফি। অভি বললো রাফি চিন্তা করো না, সময় আসুক ব্যবস্হা একটা হবেই।
রাতের নির্জনতায় রাফি চিন্তায় মগ্ন কীভাবে যে এ থিসিস টা করবে। এ চিন্তাটা তাঁকে বিষন্নতায় ডুবিয়ে রাখে। অবশেষে তাঁর বাবা রাফি কে তাঁর বন্ধু অভির সাহায্য নিতে বলেন।তিনি বলেন তোমার বব্ধু গ্রামের ছেলে, গ্রামে কোনো না কোনো জায়গায় মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ পাওয়া যাবেই। সেখানে গিয়ে অভিদের বাসায় থেকেই তুমি গবেষণা চালিয়ে যেতে পারবে।অভিকে বলেছি বাবা, সে বলেছে ব্যবস্হা একটা হবেই, জবাব দেয় রাফি।
পরের দিন অভি নিজেই রাফি দের বাসায় আসে। অভি রাফির বাবা মার সাথে কথা বলে।সে বলে আংকেল রাফি কে আমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। সেখানে হাবু নামের একজন আধা পাগল লোক থাকে, পাগলামি করলেও সে কাউকে আঘাত করে না। আপনারা চাইলে রাফি এ লোকটাকে নিয়ে গবেষণা করতে পারবে,আর আমরা তো আছি, আমাদের বাড়িতে না হয় রাফি থাকবে। সব কিছু শুনে রাফির মা বাবা রাজি হয়ে যায় এ ভেবে যে অন্তত তাঁর বন্ধু অভি তো আছে, ইনশাআল্লাহ কোন সমস্যা হবে না।
যেই কথা সেই কাজ সবার কথামতো রাফিও রাজি হয়ে যায়।সপ্তাহ খানেক পর রাফি তার প্রয়োজনীয় সকল কিছু গুছিয়ে নিয়ে অভিদের গ্রামের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে সংগে তাঁর বন্ধু, নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতিক প্রিয় অভি।গ্রামে এর আগে রাফি কখনো যায় নি।রাফির বাবা অনেক আগে থেকে বলতে গেলে রাফির দাদার সময় থেকই শহরে বাস করে। এজন্য রাফির গ্রামের পরিবেশ কেমন তা দেখা হয়ে ওঠেনি।
ট্রেন যখন রসুল পুর ষ্টেশনে দাঁড়ালো তখন আকাশে অনেক মেঘ জমতে শুরু করে । বাতাসের বেগ একটু বেশিই ছিলো যার দরুন রাফির এলো চুলগুলো আরও এলোমেলো হতে থাকে।দূরের আকাশের শেষ প্রান্তে যেন একটুকরো ছবির মতো দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা গ্রাম রসুল পুর। ষ্টেশনে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল তাদের পাশের বাড়ির রহমত মামা। অতি দ্রুত তিনি অভিদের নিকট ছুটে এলেন, সকল ব্যাগ নিয়ে নিলেন নিজ কাঁধে। তাঁরা একসাথে বাড়ির পথ ধরলো।
দুপাশে সবুজ পাতার সমাহার, জমির ভিতরে কেউ বা কাজ করছে কেউ আবার জমির পানিতে মাছ শিকারে ব্যাস্ত।
হটাৎ বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলো । রহমত চাচা আগে থেকেই দুটো ছাতা নিয়ে এসেছিলো, সেগুলো অভি ও রাফির হাতে দিয়ে আবারও পথ ধরলো। গ্রেমের মেঠোপথ কাঁদা মাখা পিচ্ছিল রাস্তাতে রাফির হাটঁতে কষ্ট হচ্ছিলো বৈকি।
বাড়ির একদম নিকটে আসতেই পা পিছলে রাফি পরে গেলো। সারা শরীর কাঁদা পানিতে মেখে একাকার।
অবশেষে তারা বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হলো। অভির মা বারান্দায় রান্না করছিল, দৌড়ে এসে তিনি অভি কে বললেন একি বাবা তোরা তো ভিজে গেছিস আর এ ছেলেটার সারা শারীর কাঁদা মাখা। তারাতাড়ি গোসলঘরে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে আসো, তোমাদের জন্য মোরগ পোলাও রান্না করছি খাবে।
দুপুরের খাবার খেতে খেতে অভির মা রাফি কে অনেক কথা বললেন। তাঁর বাবা মা কেমন আছেন, রাফির আগে কী গ্রামে আসা হয়েছে? গ্রাম তাঁর কাছে কেমন লাগে? এসব আর কি। রাফি লাজুকতার সহিত উত্তর দেয়। খাওয়ার পর্ব শেরে তাঁরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার আশায় যুমতো যায়।
শেষ বিকেলে বৃষ্টির মাত্রা একটু কমতে থাকে।হালকা আলো সমেত সূর্য মামার আনাগোনা দেখা যায় পশ্চিম আকাশে। রাফি যে ঘরে ঘুমচ্ছিলো সে ঘরের দখিনা জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাস রাফির শরীর স্পর্শ করা মাত্রই তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। আনমনে সে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে থাকে। হালকা মেঘের পর পরই সুর্যের হাসি। আচমকাই তাঁর দৃষ্টি পতিত হলো জানালার ওপাশে হাস্যরত এক মেয়ের উপর।
মেয়েটি কাদা পানিতে খেলছিল আর হাসছিল। জলদি করে সে বাহিরে এসে দেখলো মেয়েটি হাসতে হাসতে হঠাৎই কান্না করছে। রাফি অবাক দৃষ্টিতে তাকে দেখছিল আর ভাবছিল কে এই মেয়ে। মেয়ে টি অপরিষ্কার জামা কাপড় পরিহিত হলেও মুখমন্ডল মারাত্মক সৌন্দর্যে এতটাই সুসজ্জিত যে, সে সৌন্দর্য উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো নেই। রাফি এতোটাই প্রভাবিত ছিলো সে সৌন্দর্যে যার দরুন সে বুঝতেই পারে নি কখন পিছন এসে দাঁড়িয়ে আছে অভি।সহসাই রাফি পিছনে তাকিয়ে অভি কে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে ঔ মেয়ে টা কে? বাবা মা হারা এতিম এক মেয়ে নাম মায়া উত্তর দিল অভি। সে এমন হাসছে আবার কান্নাকাটি করছে এমন করার কারন কী প্রশ্ন করে রাফি।
অভি বলে তাঁর বয়স যখন দশ বছর সে সময় রোড এক্সিডেন্টে ওর বাবা মা দুজনেই মারা যায়, আর মায়া মাথায় আঘাত পায় তবে সে বেচে যায়। আঘাত টা জটিল ছিল যারফলে তাঁর মস্তিষ্কে বিকৃতি দেখা দেয় । ধীরে ধীরে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। এখানে রহমত মামার কাছে তাঁর ঠাঁই হয়েছে। রহমত মামা তাঁর আপন মামা । কথাগুলো বলছিল অভি।এগুলো শুনে রাফি অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবতে থাকে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
প্রকৃতি বরষার রঙে রঙ্গিন, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি সাথে মেঘের গর্জন, মন কে উদাসী করতে এটুকুই যথেষ্ট। তবে রাফির মন অভিমানী আবহাওয়ায় জন্য উদাসী নয়।তাঁর কল্পনায় মায়ার ছায়া, মায়া নামের অপ্রকৃতস্থ কান্না আর হাসির জন্য রাফির এ-তো মায়া।
মনের গহীন থেকে কে যেন রাফি কে বলতে থাকে তুমি এ মেয়েটাকে নিয়ে গবেষণা করতে পার। রাফি তাঁর এ ইচ্ছেটুকু বাস্তবতায় রুপ দিতে চায়,অভিকে বলে আমি মায়াকে নিয়েই গবেষণা করতে চাই। ওকে কর না সমস্যা কী বলে অভি।
পরদিন সকালে রাফি মায়ার খোঁজ করছিল,পুকুরপাড়ের নারিকেল বাগানে মায়া কে দেখা গেল গাছের নারিকেল দেখছে।
একপা দুপা করে রাফি মায়ার নিকটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মায়া ওখান থেকে দৌড়ে পালালো। রাফি কিভাবে মায়ার সাথে কথা বলবে তাঁর নিকটবর্তী হবে এসব নিয়ে চিন্তিত। এরপর আরেও কয়েকটি দিন অতিবাহিত হলো।
অভির মা জানতে পারলো, রাফি মায়া কে নিয়ে তার গবেষণা মুলক কাজটি করতে চায়। রাতে খাবার সময় তিনি বললেন বাবা রাফি তুমি ঐ লোকটা কে নিয়ে গবেষনা কর যে সিদ্ধান্ত নিয়েই তুমি এখানে এসেছ। মায়া মা মরা মেয়ে ওকে বাদ দাও। রাফি কোন কথা বলে না।
পরদিন মায়া কে আর দেখা যায় না। রাফি জানতে পারে বৃষ্টি তে ভিজে মায়ার জ্বর হয়েছে। রাফি চুপিচুপি মায়ার ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পায় কাঁথায় আবৃত মায়া কাপছে। রাফি মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারে অনেক জ্বর। বালতিতে কিছু পানি নিয়ে সে মায়ার মাথায় ঢালতে থাকে। এভাবে কিছুটা সময় পানি দেয়ায় জ্বর কিছুটা কমতে থাকে। রাফির এমন সেবা মূলক আচরণে মায়ার মামা অনেক আনন্দিত হয়ে বলে বাবা আপনি খুব ভালো মানুষ। মায়ার মতোন এমন পাগলি মেয়ের যে সেবা করছেন তা কজন করে। রাফি কিছু বলে না শুধু হাসতে থাকে। সেদিনের মতো রাফি মায়া কে রেখে নিজ কক্ষে চলে যায়।
এভাবে রাফির নিবিড় পরিচর্যায় ও ঔষধে মায়া অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
আরোগ্য লাভের পর মায়া কেমন জানি রাফিকে আর ভয় পায় না। কারনে অকারনে সে রাফির নিকটবর্তী হতে চেষ্টা করতে থাকে।রাফিও সুযোগটা গ্রহণ করে অতি আদরে মায়ার যত্ন নিতে থাকে। সুযোগ পেলেই মায়ার সাথে গল্প করে,হাসাহাসি করে, বিভিন্ন খাবার এনে দেয়।
একদিন বিকালে রাফি পুকুরপাড়ে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল। এসময় মায়া চুপিচুপি এসে বসে।রাফি বুঝতে পারে মায়া আসছে। সে প্রশ্ন করে কেমন আছ মায়া। জ্বী ভালো আছি, উত্তর দেয় মায়া। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পার? প্রশ্ন করে রাফি।না বলে মায়া। রাফি বলে এসো তোমাকে মাছ ধরা শেখাবো, বলে মায়ার হাতে ছিপ তুলে দেয় এবং নিজ হাত দিয়ে মায়ার হাত শক্ত করে ধরে। এভাবে অনেক সময় ধরে তাঁরা পুকুরপাড়ে বসে থাকে। মায়া আর রাফির সম্পর্কে সৃষ্টি কর্তাও যেন খুশি।
অনেক আনন্দেই দুজনে দিনাতিপাত করতে থাকে।
একদিন রাতের বেলায় রাফি নিজেকে প্রশ্ন করে, এটা কী শুধু তাঁর গবেষণা মুলক কাজ নাকি অন্য কোন সম্পর্কে সে নিজেকে জরাচ্ছে। কেন মায়ার জন্য এতো মায়া,কেনই বা বার বার মায়ার কাছে যেতে ইচ্ছে করে তাঁর। আসলে সে বুঝতে পারে মায়াকে সে অনেক ভালবাসে।
অদিকে মায়ার ভিতর পরিবর্তন ঘটে। সে কারও কথা না শুনলেও রাফির কথা মতন চলে।রাফি খেতে বললে খায়, ঘুমাতে বলায় ঘুমিয়ে যায় আরোও কত কী।
এক জোছনা ঝরা রাতে রাফি মায়াকে বাহিরে নিয়ে এসে বলে এসো, আকাশে অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখবে এসো। মায়া অনেক খুশি চাঁদ দেখে। রাফি বলে মায়া তুমি ঐ সুন্দর চাঁদের মতোই সুন্দর তা কি তুমি বোঝ? মায়া সুস্থ মানুষের মতো উত্তর দেয়, বলে আপনি সুন্দর করে দেখেন তাই সুন্দর মনে হয়। মায়ার এমন বুদ্ধি দীপ্ত কথায় রাফি বুঝতে পারে মায়া সুস্থ হচ্ছে। এমনি করে অনেক সময় তাঁরা কাটায় জোছনায় আলোকিত এমন পরিবেশে।
রাফি এবং মায়ার এমন আচরন অভির মা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না।তিনি এর মাঝে অন্য কিছু দেখতে পান ।তাঁর সন্দেহ হয় রাফি হয়তো মায়ার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জরাচ্ছে। কথাটা তিনি ছেলে অভিকে জানায় আর সাবধান করে দিয়ে বলে দ্রুত রাফির বাবাকে তুমি খবর টি জানাও।তাঁরা এসে তাঁদের ছেলেকে নিয়ে যাক।
একদিন বেলা দ্বিপ্রহরে মায়া রাফি কে বলে আপনার বাড়ি কোথায়। মায়ার এমন প্রশ্নে রাফি পুলকিত হয় এ কথা ভেবে মায়া পুরোপুরিভাবে সুস্থ হচ্ছে, না হলে এমন প্রশ্ন সে করবে কী করে। রাফিও সুন্দর করে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেয় এভাবে দুই জন কথা আদান-প্রদান করতে থাকে। রাফির অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরিচর্যায় মায়া প্রায় সম্পুর্ণ ভাবে সুস্থ হতে থাকে।
ওদিকে রাফির বাবাকে অভি জানায় তিনি যেন অভিদের বাসায় আসেন কারন অভির মা কিছু কথা বলতে চান।
এর কয়েক দিন পর রাফির বাবা অভিদের বাড়িতে আসেন।
সুযোগ বুঝে অভির মা বলেন ভাই জান আপনার ছেলেকে নিয়েযান। কেন কী হয়েছে জানতে চায় রাফির বাবা। উত্তরে রাফি আর মায়ার সম্পর্কের সকল সীমানা তিনি রাফির বাবার কাছে তুলে ধরেন।
রাফির বাবা হতবাক সব কিছু শুনে। তিনি বুঝতে পারেন এখানে রাফিকে রাখা যাবে না। রাফি যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেজন্য তিনি রাফিকে এব্যাপারে কিছুই বলে না। কৌশলে রাফি কে বলে তাকে বাড়ি যেতে হবে কারন তাঁর মা খুব অসুস্থ। কী হয়েছে মার রাফি জানতে চায়। বাড়ি গেলেই জানতে পারবে জবাব দেয় তাঁর বাবা।
পরের দিন রাফি সব কিছু গুছিয়ে মায়ার কাছে গিয়ে বলে আমি বাড়ি যাচ্ছি, কয়েক দিন বাদেই ফিরবো। তুমি নিজের যত্ন নিও, চিন্তা করো না।
রাফির এমন কথা শুনে মায়া বাকরুদ্ধ হয়ে যায় কারন একমাত্র এই রাফিকেই সে চেনে, আপন বলতে রাফিকেই সে জানে। মায়ার পুরো দুনিয়ায় এই রাফি। মায়া কোন কথা বলে না, শুধু নিরবে দুচোখ ছাপিয়ে বৃষ্টি ঝরানো শুরু করে।
রাফি তাঁর বাবার সাথে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। যাত্রা পথেে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়া। যতদুর চোখ যায় সে দেখতেই থাকে। মায়ার কাছে পুরো দুনিয়া শুধু বিরান ভূমির মতো মনে হয়। কোন কিছুতেই সে শান্তি পায় না, কোন কথা বলে না, খায় না, ঘুমায় না। সারাদিন একা একা কী যেন বলে। মামা মায়াকে বলে খেতে তবুও সে কোন কথা বলে না।
এদিকে রাফি বাড়িতে ফিরে দেখতে পায় তাঁর মা সুস্থ। রাফি বুঝতে পারে তাঁকে মিথ্যা বলে বাড়িতে ফিরে আনা হয়েছে। সে আবার রসুল পুর যেতে চায় কিন্তু তাতে তাঁর বাবা বাঁধা দেয়।তিনি বলেন ওখানে যাওয়ার কোন দরকার নেই। লেখা পড়া ও গবেষণার জন্য যা লাগে আমি সব ব্যাবস্হা করবো। বাড়িতে
থেকেই তুমি সব কিছু করতে পারবে। রাফির মা ছেলের এমন রসুল পুর যাওয়ার আগ্রহের কারন আগে থেকেই জানতো।তিনি স্বামীকে বলেন রাফি কে যেতে দিন, কিছুই হবে না। তবে রাফির বাবার রাগের কাছে তাঁর আবদার টিকতে পারে না।
ছেলে দিন দিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজেকে ঘরের ভিতর আবদ্ধ করে রাখে। রাফির মা তখন বাধ্য হয়ে রাফি কে সব কিছু খুলে বলে এও বলে তোদের সম্পর্ক তোর বাবা কখনও মেনে নেবে না। একথা শুনে রাফিও বলে সে মরতে রাজি আছে তবুও মায়াকে ছাড়তে পারবে না।
রাফির বাবা জোর করে রাফিকে তালাবদ্ধ ঘরে আটকিয়ে রাখে। কোথাও বেরতে দেয় না।
দিন যায় মাস যায় রাফি আসে না। মায়া অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পরে। তাঁর জীবন থমকে যায়। তাঁর পৃথিবী সূর্য হীন অন্ধকারে নিমজ্জিত, এখানে না আছে আলো, না আছে বাতাস।এক মুমূর্ষু রোগীর মত নিরবে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে মায়া।
মায়ার মামা অভির মাকে বলেন আপা, মায়া মা বাবা হারা অসুস্থ
একটা মেয়ে। সে রাফি নামের ঐ ডাক্তার ছেলের পরিচর্যায় সুস্হ হচ্ছিলো প্রায়। ঐ ছেলে চলে যাওয়ার পর থেকে মায়া আবার আগের মতো আচরণ করছে। কারোই সাথে কথা বলে না।আপা রাফি কে আসতে বলেন না। তাহলে মায়া আবার সুস্হ হবে ইনশাআল্লাহ। অভির মা কোন কথাই বলেন না।
ওদিকে রাফি অসহায়ের মতো অন্ধকার ঘরে বন্দী। সেও খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে শুধু মায়ার মায়াবী মুখের পানে চেয়ে চেয়ে সময় পার করছে। কল্পনার জগতে সে শুধুই মায়া কেই দেখে আর ভাবতে থাকে কখন মায়ার কাছে যাবে ? মায়াই যেন তার পৃথিবী অন্য কিছুতে তাঁর কোন আগ্রহ নেই।
একদিন রাত্রি বেলা মায়া ঘর থেকে বের হয়। রাত্রি টা ছিল চাঁদনী রাত।ভরা পূর্ণিমায় বাঁধ ভাঙা জোছনার হাসিতে চারপাশ মুখরিত। মায়া অজানার পথে হাঁটছে, সাথে সাথে ঐ আকাশের গায়ে লেগে থাকা চাঁদ ও হাঁটছে। মায়ার নিরবতা যেন প্রকৃতিকেও নিরব করে দিয়েছে। মায়া জানে না সে কোথায় যাবে তবে যে পথে সে রাফিকে যেতে দেখেছিল, সে পথ ধরেই মায়া চলতে থাকে।
পরদিন সকালে মায়া কে কেথাও পাওয়া যায় না। মায়ার মামা অভির কাছে এসে বলেন বাবা, মায়াকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না! তুমি একটু খুজে দেখনা বাবা, তোমার মা কে বলো একটু খুজতে। সারা গ্রামের প্রতিটি যায়গায় তন্নতন্ন করে খুজেও মায়া কে পাওয়া যায় না।
এভাবে প্রায় সপ্তাহ খানিক পর পাশের গ্রামে একটা মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নদীতে মাছ ধরার সময় জালে এ মরদেহ উঠেছিল। খবর টা যখন পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরে তখন মায়ার মামা, অভি এবং অভির মা সে লাশ দেখতে গিয়ে দেখে এ মরদেহ আর কারো না, এটা যে অভাগী মায়ার লাশ।
পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। প্রকৃতি নিরব, সূর্যের আলোতেও যেন কান্নার প্রতিধ্বনী, বাতাসে দুখের মাতম।
মায়া কে নিয়ে আসা হয় রসুল পুরে। শেষ গোছল করিয়ে কাফন পড়িয়ে মা বাবার কবরের পাশে তাঁকেও কবর দেয়া হয়।
অপর দিকে রাফিরও প্রায় মর মর অবস্থা। ডাক্তার বলেন রাফিকে সুস্থ করতে চাইলে মায়া নামের ঐ মেয়ের কাছেই তাকে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে রাফি কে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
বাদ্ধ হয়ে রাফি কে আবার রসুল পুরেই নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, রাফি এসে শুনতে পায় পুরো ঘটনা।মায়ার জীবেনর শেষের কয়েকটা দিনে কী যটেছিল, রাফি বিনা মায়ার কীভাবে দিন কেটেছিল সব শুনে রাফি নিস্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মায়ার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাফি। চোখের পানিতে শেষ বিদায় জানাচ্ছে মায়া কে, এমন হৃদয় নিংড়ান ভালবাসার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ার কবরের উপরের কদম গাছটি।
কদম পাতার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মায় ও রাফির বিরহী প্রেম কাব্য
আজও এ কদম বৃক্ষ টি পথচারীদের কাছে মায়ার গল্পটি বলে চলেছে তবে ভাষায় নয়, নিরবতায়।
রাফি আর বাড়ি ফিরে যায় নি! তার শেষ ঠিকানা ঐ দখিনা জানালা, যে জানালায় সে প্রথম মায়া কে দেখেছিল। সারাদিন জানালার পাশে বসে থাকে আর ভাবে কখন মায়া জানালার পাশে আসবে, হাসবে আবার কাদবে। জানালা দিয়ে সে আকাশ দেখে, আকাশের চাঁদ কে তাঁর কাছে মায়ার মতো মনে হয়। চাঁদের সাথে কথা বলে, বৃষ্টির কাছে আবেদন জানায় সে যেন মায়া কে নিয়ে আসে। এভাবে একসময় রাফি সত্যি সত্যি মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষে পরিণত হয়।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কে জানতো মানসিক ভারসাম্যহীন লোক নিয়ে গবেষণা করতে এসে রাফিও মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটলো।
রাফির এখন ঠিকানা মায়ার কবর
আর ঐ দখিন জানালা!
লেখক : মো: শাহ জালাল
শিক্ষক ও লেখক
- ০১৭৩৬৩৫৬৪৪৩