১.
১৯৮৫ সাল, পাকিস্তান।পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউল হক। পাকিস্তানে মিলিটারি ক্যু, সামরিক শাসন এগুলো নতুন কিছু নয়, তারই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭৭ সালে মিলিটারি ক্যু এর মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভূট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে, পাকিস্তানের মসনদে বসেন জিয়াউল হক। জিয়াউল হক এর শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কট্টর ডানপন্থী নীতি।হুদুদ অধ্যাদেশ প্রয়োগ, শরিয়া আদালত সহ আরো অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা আরো বেশি টালমাটাল হতে শুরু করে, এ নিয়ে শহরের উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের উদারপন্থীদের মাঝে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এর মধ্যেই আরো অদ্ভুত এক আইন করে বসে জিয়া সরকার।পাকিস্তানের জাতীয় টেলিভিশনে নারীদের শাড়ি পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, এবং সাধারণ নারীদের শাড়ি পরিধানকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বলা হয় শাড়ি পাকিস্তানের সংস্কৃতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয় বরং শাড়ি হিন্দুয়ানি বা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক!
সামরিক স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লাহোরে হাজার হাজার মানুষের সামনে, কালো শাড়ি পরে মঞ্চে উপনীত হন ৫০ বছরের এক গজলশিল্পী ইকবাল বানো।তিনি গাইবেন এক নিষিদ্ধ কবির গান, “হাম দেখেঙ্গে”
পঞ্চাশ হাজার মানুষের সামনে ইকবাল বানো গেয়ে উঠলেন,
হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে লাযিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে;
আমরা দেখব, আমরা দেখব নিশ্চিত জানি, আমরাও দেখব;
স্ব তাজ উছালে জায়েঙ্গে স্ব তখ্ত গিরায়ে জায়েঙ্গে
সকল মুকুট ছুড়ে ফেলা হবে সকল সিংহাসন গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
৫০ হাজার উন্মত্ত মানুষ এর সম্মিলিত,”ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে যেন পুরো লাহোর!
ফ্যাসিস্টদের সাধারণ স্বভাবমতোই নিষিদ্ধ হন ইকবাল বানো, আরো একবার নিষিদ্ধ হয় সেই গান, মৃত কবিকে আখ্যা দেয়া হয় দেশদ্রোহী, মৃত কবির গান কে বলা হয় পাকিস্তানবিরোধী।
২.
এই ঘটনার বিয়াল্লিশ বছর পর, ২০২০ সাল।ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে প্রণীত সিএএ ও নাগরিক নিবর্তনমূলক এনআরসি আইনের প্রতিবাদে জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া দিল্লির শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে সরব হন। পুলিশ তাদের ওপর বেধড়ক অত্যাচার করে, প্রতিবাদে ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি কানপুর ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করে ১৭ নভেম্বর, এবং তাদের কণ্ঠে শোনা যায় সেই গান, “হাম দেখেঙ্গে”
কী আশ্চর্যের বিষয়, যেই গান একসময় পাকিস্তানে আক্রান্ত হয়েছিল পাকিস্তানবিরোধিতার অভিযোগে, সেই একই গান ৪২ বছর পর ভারতে এসে হয়ে যায় ভারত বিরোধী! গানটির একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে গোদি পান্ডাদের আস্ফালান শুরু হয়, এই গানের বিরুদ্ধে, এই গানে নাকি এন্টি হিন্দু সেন্টিমেন্ট কে উৎসাহিত করা হয়েছে।
যেদিন এই দুনিয়ার খোদার কাবা থেকে/সব মূর্তিগুলো পিটিয়ে অপসারিত করা হবে/পবিত্রঘর থেকে বিতাড়িত আদিপবিত্র মানুষগুলোকে যেদিন/আল্লার ঘরে তুলে এনে ফের অধিষ্ঠিত করা হবে পবিত্র মসনদে/আর সব মুকুটগুলো ছুড়ে ফেলা হবে ঊর্ধ্বাকাশে/আর শাসকের তখত গড়াগড়ি খেতে থাকবে নিচে, মাটিতে/… ব্যস, শুধু সেই এক এর নাম থাকবে- আল্লাহ’ (তর্জমা : ফরহাদ মজহার)
ভারতের বিখ্যাত স্ক্রিনরাইটার, লিরিসিস্ট জাভেদ আখতার কে ন্যাশনাল টেলিভিশন এ এসে ব্যাখ্যা করতে হয়, যে কবি এখানে মেটাফোর হিসেবে ব্যাবহার করেছেন মূর্তিকে, যেখানে মুর্তি স্বয়ং জালিম শাসকের প্রতিরূপ।
কবিতা কত শক্তিশালী হতে পারে, কবির রচনা কতটা শক্তিশালী হতে পারে যে জীবন নদীর ওপার থেকে এসে কবির লিখা অক্ষরগুলো চেপে ধরে জালিমদের গলা!
কবি পরলোকগত হতে পারেন, পেরিয়ে যেতে পারে মহাকাল, বদলে যেতে পারে সীমানা, কিন্তু ফ্যাসিস্টের চরিত্র একই থেকে যায়, আর দেশ, কাল, সীমানা ভেদে জ্বলতে থাকে কাব্যের অগ্নিশিখা।
পৃথিবীর যেখানেই নাগরিক অধিকার হনন হয়, জালিমের মাংসাশী দাঁত কামড় বসায় অসহায় মানুষের অধিকারে, সেখানেই কবিতা আবির্ভাব হয় অনিবার্য ভাবে, কবি আবির্ভূত হন অনিবার্য ভাবে।
তেমন ই এক কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, হাম দেখেঙ্গের রচয়িতা।
৩.
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আপাদমস্তক একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী, পুরোটা জীবন তিনি লড়ে গেছেন নিপীড়িতদের হয়ে, মেহনতি মানুষদের পক্ষে।কলম ধরেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে, সশরীরে যুক্ত হয়েছেন জনতার সংগ্রামে, বারবার চক্ষুশূল হয়েছেন তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের, তার কবিতার উপর আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এবং তাকে জেলেও যেতে হয়েছিল বারংবার। ৭১ এ যখন পাকিস্তানি আর্মি বাঙালীদের গণহত্যা শুরু করেছে, তখনো তিনি কলম ধরেছিলেন আমাদের পক্ষে, লিখেছিলেন, ‘সাজাবো, তবে কিভাবে সাজাবো গণহত্যার শোভাযাত্রা/আমার রক্তের চিৎকারে আকর্ষণ করব কারে?’ ‘বাংলাদেশ-২’ নামক কবিতায় লেখেন, ‘প্রতিটি গাছ রক্তের মিনারের মতো/প্রতিটি ফুলও রক্তমাখা/প্রতিটি চাহনি যেন রক্তের বর্শার তীর’।
৪.
ফয়েজ আমার অন্যতম প্রিয় একজন কবি।ফয়েজের দুটি কবিতা অনুবাদের ধৃষ্টতা করেছি আমি।প্রথম কবিতাটির নাম, “মুঝসে পেহলি সি মোহাব্বাত”
ফয়েজ প্রথম যেদিন মার্ক্সের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়েন, সেদিন তিনি এই কবিতাটি লিখেন।
mujh se pahlī sī mohabbat mirī mahbūb na maañg
maiñ ne samjhā thā ki tū hai to daraḳhshāñ hai hayāt
terā ġham hai to ġham-e-dahr kā jhagḌā kyā hai
terī sūrat se hai aalam meñ bahāroñ ko sabāt
terī āñkhoñ ke sivā duniyā meñ rakkhā kyā hai
tū jo mil jaa.e to taqdīr nigūñ ho jaa.e
yuuñ na thā maiñ ne faqat chāhā thā yuuñ ho jaa.e
aur bhī dukh haiñ zamāne meñ mohabbat ke sivā
rāhateñ aur bhī haiñ vasl kī rāhat ke sivā
an-ginat sadiyoñ ke tārīk bahīmāna tilism
resham o atlas o kamḳhāb meñ bunvā.e hue
jā-ba-jā bikte hue kūcha-o-bāzār meñ jism
ḳhaak meñ luThḌe hue ḳhuun meñ nahlā.e hue
jism nikle hue amrāz ke tannūroñ se
piip bahtī huī galte hue nāsūroñ se
lauT jaatī hai udhar ko bhī nazar kyā kiije
ab bhī dilkash hai tirā husn magar kyā kiije
aur bhī dukh haiñ zamāne meñ mohabbat ke sivā
rāhateñ aur bhī haiñ vasl kī rāhat ke sivā
mujh se pahlī sī mohabbat mirī mahbūb na maañg
আমার কাছে আর আগের মতো প্রেম চেও না তুমি প্রিয়া
আমি তো ভাবতাম, তুমি আছো বলেই আমার এ জীবন আলোয় উদ্ভাসিত
তোমার বিরহ আছে বলেই, দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ আমার কাছে মিথ্যে
তোমার এই সুন্দর মুখ আছে বলেই, এই পৃথিবীতে এখনো বসন্ত আসে,
তোমার সুন্দর চোখ ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কী বা আছে?
তুমারে যদি পাই, এই দুনিয়ার সব ভাগ্য হবে আমার করতলগত,
আমার সকল সাধ পূরণ হলো, তারপর আমি কী দেখলাম?
ভালোবাসার বাইরেও আরো কত দুঃখ এই যামানায়,
সঙ্গমের সুখ ছাড়াও আরো কত সুখ আছে এই যামানায়!
শত শতাব্দীর কত অন্ধকার আর নিষ্ঠুর সব জাদু বোনা হচ্ছে রেশম, আটলাস আর দামী সব কাপড় দিয়ে, আর বুনছে যেইসব শরীর,
সেইসব শরীর রাস্তায় রাস্তায়, আর বাজারে বাজারে বিক্রি হচ্ছে,
রক্তস্নাত সেইসব শরীর গড়াগড়ি খাচ্ছ রাস্তায় রাস্তায়।
তাদের শরীর যেন বের হয়ে এসেছে কোনো অসুখের গরম চুল্লি থেকে
দেহের গলিত ক্ষত থেকে বের হচ্ছে পুঁজ।
তোমার সুন্দর মুখ আজ ও আমারে আগের মতো মুগ্ধ করে কিন্তু,
এই অসুন্দর সব জঞ্জালের দিকে আমার দৃষ্টি চলে যায় বারবার, তো আমি কী করব!
ভালোবাসার বাইরেও আরো কত দুঃখ এই যামানায়,
সঙ্গমের সুখ ছাড়াও আরো কত সুখ আছে এই যামানায়!
তাই আমার কাছে আর আগের মতো প্রেম চেও না তুমি প্রিয়া!
বিপ্লবী ফয়েজের নির্মল একটি রোমান্টিক মন ছিল, জীবদ্দশায় রচনা করেছেন অসংখ্যা প্রেমের কবিতা।
আমার খুবই পছন্দের তেমনই একটি কবিতা, “রাকীব সে”।উর্দু ভাষায় “raqeeb” শব্দের অর্থ “rival in love”, অর্থ্যাৎ সেই ব্যাক্তি, যে কীনা প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা যার সাথে প্রেম শেয়ার করা হয়।
ফয়েজের জন্ম পাকিস্তানের শিয়ালকোটে, সেখানকার প্রতিবেশী এক কিশোরীর প্রেমে পড়েন ফয়েজ।কিছুদিন পর সেই কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র আর ফয়েজ ও বেরিয়ে পড়েন উনার কবিতা এবং বিপ্লবের সান্নিধ্যে।
এর পর বেশ কিছু দিন কেটে যায়, ফয়েজ তখন পাকিস্তানের সবচে জনপ্রিয় কবি।ফয়েজ বেড়াতে আসেন তাঁর জন্মস্থানে।কাকতালীয় ভাবে সেখানে ফয়েজের দেখা হয়ে যায় কৈশরের সেই ভালোবাসার মানুষের সাথে। তাদের দুজনের মধ্যে কথা হয়, এবং সেই ভদ্রমহিলা ফয়েজকে উনার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, উনার স্বামী ফয়েজের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন।
এই ঘটনাটিই ফয়েজের “রাকিব সে” কবিতার ইন্সপিরেশন হিসেবে কাজ করে।
কবিতার প্রথম স্টানজায় কবি বলছেন,
“aa ki vābasta haiñ us husn kī yādeñ tujh se
jis ne is dil ko parī-ḳhāna banā rakkhā thā
jis kī ulfat meñ bhulā rakkhī thī duniyā ham ne
dahr ko dahr kā afsāna banā rakkhā thā
(তোমার সাথে বাধাঁ আছে সেই মায়াবিনীর স্মৃতি
যে আমার এ হৃদয়কে স্বর্গ করে রেখেছিল
যার ভালোবাসায় আমি ভুলে গিয়েছিলাম দুনিয়া
এই মহাকালকে দেখেছিলাম এক মিথ্যে গল্পের মতো)
এখানে ফয়েজ সেই প্রথম প্রেমের সময়ের কথা বলছেন, যখন প্রেমের উন্মত্ততায় তিনি বুদ হয়েছিলেন।
āshnā haiñ tire qadmoñ se vo rāheñ jin par
us kī mad.hosh javānī ne ināyat kī hai
kārvāñ guzre haiñ jin se usī rānā.ī ke
jis kī in āñkhoñ ne be-sūd ibādat kī hai
(তোমার পদতলের সেই পথ তোমাকে আজো মনে রেখেছে বড় ভালোবেসে,
যেই পথে পার হয়েছে তোমার মত্ত যৌবন
তোমার সৌন্দর্য্যের যত কাফেলা চলে গেছে এই পথ ধরে
যার নিস্ফল উপাসনা করে গেছে আমার এ দুটি চোখ!)
এই পঙক্তিতে ফয়েজ সেই মানুষটির সৌন্দর্য্যের বর্ণনা এমন ভাবে দেন যেন সেই মানুষটি বা তার সৌন্দর্য কোনো একক মানুষের নয় বরং এটি যেন একটি কাফেলা, তিনি যেন বলতে চাইছেন সেই প্রশস্ত সৌন্দর্যের কাফেলায় উনি চারিদিকে বেষ্টিত এবং তার দুই চোখ সেই সৌন্দর্যের নিঃস্বার্থ পূজা করে!
কবিতাটির এই পর্যন্ত সব স্বাভাবিক, ফয়েজ তার ভালোবাসার সেই মানুষটিকে নিয়ে, তার সৌন্দর্য্যকে নিয়ে এবং সেই ভালোবাসার সময়কে নিয়ে কথা বলছেন।এর পংক্তি থেকে কবিতাটি একটি ইন্টারেস্টিং মোড় নে।পরের অংশটুকু এরকম,
tujh se khelī haiñ vo mahbūb havā.eñ jin meñ
us ke malbūs kī afsurda mahak baaqī hai
tujh pe barsā hai usī baam se mahtāb kā nuur
jis meñ biitī huī rātoñ kī kasak baaqī hai
সেই প্রিয় বাতাসেরা তোমার সাথে খেলেছে,
যেখানে এখনো তার ক্ষীণ সৌরভ রয়ে গেছে
যেই রাতে এখনো রয়ে গেছে আদিম বেদনারা
সেই রাতের চাঁদের আলো তোমার উপর পড়েছে!
tū ne dekhī hai vo peshānī vo ruḳhsār vo hoñT
zindagī jin ke tasavvur meñ luTā dī ham ne
tujh pe uTThī haiñ vo khoī huī sāhir āñkheñ
tujh ko ma.alūm hai kyuuñ umr gañvā dī ham ne
তুমি ত দেখেছ সেই কপোল, সেই গাল, সেই ঠোঁট
যাদের কল্পনায় আমি বিলিয়ে দিয়েছি আমার এই জীবন!
তোমাকেই দেখেছে সেই মায়াবী করুন চোখ
তাই তুমি জানো, কেন আমি আমার পুরো জীবন বিলিয়ে দিলাম!
ham pe mushtarka haiñ ehsān ġham-e-ulfat ke
itne ehsān ki ginvā.ūñ to ginvā na sakūñ
ham ne is ishq meñ kyā khoyā hai kyā sīkhā hai
juz tire aur ko samjhā.ūñ to samjhā na sakūñ
ভালোবাসার বেদনা আমাকে বড় রহম করেছে
এতটাই যে যদি গুনতে বসি, গুনে শেষ করা যাবেনা
এই প্রেমে আমি কী হারিয়েছি আর কী শিখেছি
তা তুমি ছাড়া আর কাউকে বোঝাতে চাইলে বোঝাতে পারব না!
কবিতাটির এই অংশে ফয়েজ কথা বলছেন, ফয়েজের ‘রাকীব’ এর সাথে।তিনি বলছেন, আর কেউ জানবে না কিন্তু তুমি ত জানবে, তুমিই ত বুঝবে কেন আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিলাম তার জন্য, কারন তুমিই দেখেছ সেই চোখ, গাল, কপোল, তোমার উপরেই পড়েছে তার চোখ, তুমিই তো আমাকে বুঝবে!
সাধারণত কেউ ভালোবাসার ভাগ দিতে চায় না, কল্পনাতেও প্রেমিকার পাশে অন্য কাউকে স্থান দিতে পারে না কেউ।এ জন্যই কবিরা হয়তো অনন্য, ফয়েজ উনার প্রতিদ্বন্দ্বীকে এড্রেস করছেন এম্পেথি দিয়ে, তার প্রতি ফয়েজের কোনো বিরাগ নেই, বরং ফয়েজ বলতে চাইছেন, যে আমি তার জন্য কী অনুভব করি সেটা তো তুমিই বুঝতে পারবে কেননা তুমি তাকে পেয়েছো, তার ভালোবাসাকে পেয়েছো! তার বিরহের বেদনা ফয়েজের ওপর কেন বর হিসেবে কাজ করেছে, কতটা কৃতজ্ঞ উনি তার সেই প্রেমের বেদনার প্রতি সেটা তো সেই মানুষ ছাড়া আর কেউ বুঝবেনা!
কবিতাটির এই অংশে, প্রেমিক ফয়েজের জায়গায় প্রবেশ করেন বিপ্লবী ফয়েজ। ফয়েজ এর অসাধারণ একটি গুণ হচ্ছে, তার কবিতায় ভাবের পরিবর্তন, এবং এই ভাবের পরিবর্তন টা এতটা সাবলীল, এতটা অনবদ্য যা ফয়েজকে তার সমসাময়িক কবিদের থেকে অনন্য করে তোলে।
ājizī sīkhī ġharīboñ kī himāyat sīkhī
yās-o-hirmān ke dukh-dard ke ma.anī sīkhe
zer-dastoñ ke masā.ib ko samajhnā sīkhā
sard aahoñ ke ruḳh-e-zard ke ma.anī sīkhe
শিখেছি নম্রতা, শিখেছি গরিবের পাশে দাঁড়াতে
জেনেছি হতাশা আর বেদনার গভীর অর্থ
নিপিড়ীতদের দুঃখ ও কষ্ট
আর নিঃশ্বাসের হতাশা, বিবর্ণ চোখেদের ভাষা!
jab kahīñ baiTh ke rote haiñ vo bekas jin ke
ashk āñkhoñ meñ bilakte hue so jaate haiñ
nā-tavānoñ ke nivāloñ pe jhapaTte haiñ uqaab
baazū tole hue mañDlāte hue aate haiñ
যখন কোথাও বসে কাঁদে অসহায় পরাজিত মানুষ
যাদের অশ্রু চোখের পাতায় কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পড়ে
তাদের গ্রাসের উপর কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে বাজপাখি
ডানা মেলে উড়ে এসে!
jab kabhī biktā hai bāzār meñ mazdūr kā gosht
shāh-rāhoñ pe ġharīboñ kā lahū bahtā hai
aag sī siine meñ rah rah ke ubaltī hai na pūchh
apne dil par mujhe qaabū hī nahīñ rahtā hai
যখন বাজারে বিক্রি হয় শ্রমিকের দেহ
রাজপথে গরিবের রক্ত বয়
তখন আমার হৃদয়ে এক আগুন জ্বলে ওঠে
আমার হৃদয়কে আমি আর সামলাতে পারি না!
৫.
ছোটবেলা থেকে আমি সবসময় পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে শিখে এসেছি, শিখেছি পাকিস্তানি মাত্রই আমাদের শত্রু। জাফর ইকবালদের মতো মানুষ, যাদের আমরা দেবতাজ্ঞান করতাম, উনারাই ত আমাদের শিখিয়েছেন পাকিস্তানের ওপর দিয়ে কোনো প্লেন গেলে, স্যার সেই প্লেনে ওঠেন না, কোনো পাকিস্তানির সাথে আমাদের বাংলাদেশিদের সম্পর্ক থাকতে পারে না!
আমরা সেই ঘৃণার বীজ বুকে নিয়ে বড় হই, আমরা বুঝতে পারি না, আমাদের বুঝতে দেয়া হয় না যে পৃথিবীর বুকে আপামর সব নিপীড়িত মানুষদের আলাদা কোনো পরিচয় হয় না! পাকিস্তানের বেলুচ গরিব ক্ষুদার্থ কৃষক আর আমাদের বাংলাদেশের তিন মাস বেতন না পাওয়া পোশাকশ্রমিকের মাঝে আদতে কোনো পার্থক্য নেই! আর ঠিক তেমনি পার্থক্য নেই স্বৈরাচারীদের মাঝেও।ভারতের মোদি, পাকিস্তানের আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান আর হাসিনার চরিত্র মূলত একই।
আমাদের ঘৃণার ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়, আমরা বুঝতে পারিনা, আমরা জানতে পারিনা আমাদের মূল লড়াইটা আসলে কাদের বিরুদ্ধে।আমাদের তাই আবারো ফিরে যেতে হবে আমাদেরই পূর্বপুরুষদের কাছে, নত মস্তকে সেলাম করে আমাদের বুঝতে হবে কেন আজো ফয়েজ প্রাসঙ্গিক, কেন আমাদের ফিরে যেতে হবে সাদাত হাসান মান্টোতে, আমাদের জানতে হবে মীর্জা গালিব কে, আল্লামা ইকবাল কে, আমাদের আপন করে নিতে হবে ভগত সিং কে।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ