অপরাধবোধ
আমার বাবা মা সেকেলে হলেও যথেষ্ট আধুনিক জীবনযাপন করতেন। তাই তিন ছেলেমেয়ের পর আর কোনো বাচ্চাই নিতে চান নাই। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেদিন মা বুঝলেন আমি তাঁর পেটে। বাবা মা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই বাচ্চা তাঁরা গর্ভপাত করাবেন। অতঃপর তাঁরা একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হলেন। ডাক্তার সাহেব মাকে পরীক্ষা করে বললেন, একি, আপনার বাচ্চা তো পাঁচ মাসের হয়ে গেছে, এখন গর্ভপাত করলে আপনার জীবন সংশয় আছে। আপনি দেরী করে ফেলেছেন। এখন গর্ভপাত আর সম্ভব নয়। মা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন।
অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের অযাচিত আগমন রোধ করতে না পারায় বাবা নিজের কাপুরুষতাকে ক্ষমা করতে পারলেন না। তিনি হাল ছাড়লেন না। আমার আধুনিক বাবা তাঁর এক বন্ধুর কাছে একজন নার্সের খোঁজ পেলেন যে কিনা তুড়ি মেরে পেটের বাচ্চা ফেলে দেয়। যদিও তাঁরা জানতেন, সাত/আট মাসের বাচ্চাও গর্ভপাত করানো হয় তবে সেসব গর্ভপাত করে আনাড়ি নার্স, ধাই যেখানে প্রচুর গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুও হয়।
মৃত্যুভয়কে দ্বিধাহীন ভাবে অগ্রাহ্য করে বাবা মা নার্সের কাছে গেলেন। আমাকে মারবার জন্য তাঁরা সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। নার্স মাকে টেবিলে শুইয়ে কি যেন করেছিল। এরপর থেকে রক্তপাত শুরু হয়। এক পর্যায়ে মাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেই আমলে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ছিল অভিজাত হাসপাতাল। ডাক্তাররা মায়ের চিকিৎসা করে মাকে সুস্থ্য করে তুললেন কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, ডাক্তাররা অত্যান্ত আনন্দের সাথে বাবাকে জানালেন পেটের বাচ্চাটা সুস্থ্য আছে এখনও। তবে কিছুটা আশঙ্কা তো রয়েই যায়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাবধানে রাখবেন আর ঔষধগুলো ঠিকমতো খাওয়াবেন। সমস্যা হলে আবারও নিয়ে আসবেন।
মা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসাতে বাবা অত্যন্ত আনন্দিত। কিন্তু সেই আনন্দের মাঝেও আমার সুস্থ্য থাকার বিষয়ে তাঁরা চরম হতাশ ও বিষাদগ্রস্ত । হতাশা নিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন , কবে মায়ের রক্তপাত শুরু হবে, কবে আবারও হাসপাতালে যাবে, কবে আমি নিজে থেকেই মরে যাবো। কিন্তু হায়, এমন কোনো সুখকর ঘটনা ঘটলোই না।
অতঃপর, এক চৈত্রের দুপুরে সুর্য্য যখন মাথার আধ হাত উপরে মাত্র, চারদিকে ঠা ঠা রোদ্দুর, মাঠ মাটি ফেটে চৌচির ঠিক তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমি সুস্থ্যভাবেই ভুমিষ্ঠ হলাম। আমার বড় দুই ভাইবোন যারা নিজেরাও তখন ছোট তারা পুরো গ্রামে রটিয়ে দিল, আমাদের একটা ভাই হইছে। খবর শুনে অনেকে আসলো। বাবার পাতানো বোন আনু পিসিসহ হিন্দু পাড়ার আরও কয়েকজন বউ ঝি কুলা ডালা মাটির হাড়ি কলস সাজিয়ে বাড়িতে এসে উঠানে দাঁড়িয়ে উলু দিতে লাগলেন। উল্লেখ্য, সে আমলে হিন্দু মুসলমান পরিবারগুলোর সম্প্রীতি খুব সমৃদ্ধ ছিল। উলুধ্বনি শুনে আঁতুড়ঘর থেকে ধাই দাদি বেরিয়ে এসে কারণ জানতে চাইলেন। শহুরে একজন এলএমএফ পাশ করা সরকারি ডাক্তারও বারান্দায় বসেছিলেন। তিনিও উলুধ্বনির কারণ জানতে চাইলেন। আনু পিসি কুলাডালা নাচায়ে বললেন, বৌঠানের ছুয়াল হইয়েসে আর উলু দেবো না? আ লো কাকী, তোর মুখখানা এতো ভার কেনে রে? ছুয়াল কি কালা হয়লো??? কালা হইয়েসে তো কি হইয়েসে। আ লো কাকী, সুনার আংটি ব্যাঁকাও ভাল। ধাই দাদি একরাশ ঝাঁঝের সাথে বললেন, ছুয়াল হলি তো হতই, হইয়েসে মায়ের কঁচু ।
অন্নপূর্ণা পিসি মানে আনু পিসিরা নাচ বন্ধ করে থমকে দাঁড়ালো। মাটির হাড়ি কলসী ডালাকুলো রক্তজবার তোড়া উঠানে আছড়ে ভেঙ্গে পিসে পায়ে দলে আনন্দমুখর রমনীবৃন্দ রাগান্বিত হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে তৎক্ষনাৎ বাড়ি ত্যাগ করলো।
আমার আগমন আমার আধুনিক বাবামায়ের কাছে অবাঞ্চিত হলেও সন্তানের লিঙ্গ বৈষম্যের বিপক্ষে তাঁদের অবস্থান ছিল। এ বিষয়ে তাঁরা অত্যন্ত উদার ছিলেন। অতএব, আমাকে মেনে নিতে খুব বেশী সময় তাঁরা ব্যয় করেন নাই। অবশ্য আমার সৌন্দর্য্যেও এখানে একটি অগ্রাহ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বড় হয়ে শুনেছি, আমি নাকি চৈত্রের আগুনরঙ শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম। আর মাথাভর্তি কালো কোঁকড়ানো চুলও ছিল। আমার জন্মের কথা জেনে আনু পিসি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এজন্যে আনু পিসিকে মা ক্ষমা করেন নাই। পিসির সাথে মা বছর পাঁচেকের মত কথাও বলেন নাই, চিঠির উত্তরও দেন নাই। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে মায়ের অজান্তে আনু পিসি আমাকে কোলে করে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে নাড়ু মোয়া খাওয়াতেন আর আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদতেন। বছর পাঁচেকের আমি মাকে নাকি জিগেস করেছিলাম, মা, আমাকে কোলে নিয়ে আনু পিসি কাঁদে কেন? মা, তুমি আনু পিসির বাড়িতে গেলে বকো কেন? মা, তুমি নাড়ু ফেলে দিলে? পিসিই তো দিছে আমাকে, আমি তো পিসিকে না বলে নেই নাই মা। উল্লেখ্য, আনু পিসির স্বামী শহরে থাকতেন তাই পিসি তাঁর দুই ছেলে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতেন যা কি না আমাদের গ্রামের হিন্দুপাড়া বলে সবাই জানতো।
আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে নিজ জন্ম ইতিহাসের এইসব বীভৎস কাহিনী শুনে। স্কুলে আমার রেজাল্ট যখন খুব ভাল হতো তখনই মা বড়ই আহ্লাদিত হয়ে সবাইকে এইসব গল্প শুনাতেন। আমার শিশুমন তখন কী এক ভয়াবহ বিষন্নতায় নিস্তেজ হয়ে যেতো। কেউ বেড়াতে আসলে যখন আদর করে আমাকে কোলে তুলে নিতো কিংবা গাল টিপে দিতো তখন মা গর্বিত কন্ঠে আমার জন্ম ইতিহাস বলা শুরু করতেন আর আমার ছোট্ট মনটা অবনত শিরে সেই দুরন্ত শৈশব কৈশোরে একেবারেই না জানা, না চেনা ঈশ্বরকে ধিক্কার দিতো। এমনকি, আমি যখন মেডিকেলে চান্স পেলাম তখনও মা সবাইকে ডেকে ডেকে জানালেন আমার পৃথিবীতে আসার অদম্য যুদ্ধাংদেহী ইচ্ছার ইতিহাস। আচ্ছা,
মা কি বুঝতেন না, এই ইতিহাসের আড়ালে প্রকটভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক নির্মম অবহেলা, ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যান, হত্যার নির্দয় বাসনা?
দীর্ঘ বছর পেরিয়ে গেছে। বাবামায়ের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত আজ। আমার বিয়ে, সংসার, সন্তান, চাকরি হয়েছে। তারপরও বাবা মায়ের প্রতি কি এক অমোঘ আকর্ষণে আমি তাঁদের না দেখে এক সপ্তাহের বেশী থাকতে পারিনা। এমনও হয়েছে, বাবা অথবা মা কেউ অসুস্থ হলেই আমার বাচ্চাদের তাদের বাপের কাছে রেখে আমি মায়ের বাড়িতে থেকেছি।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য সব ধরনের চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘদিন ভুগে বার্ধক্যজনিত রোগে বাবা আমার কোলে মাথা রেখে মারা গেলেন। আমার মা তখনও আমাকে নিয়ে গর্ব করেছেন আর মৃত বাড়িতে আগত আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের আমার জন্ম ইতিহাস বলেছেন। সাথে বলেছেন, ভাগ্যিস, আমরা হেরে গেছিলাম।
মা তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর আমার কাছে ছিলেন । তিনি তখন অশীতিপর বৃদ্ধা। মায়ের সবধরনের যত্ন, সেবা, মেডিকেল সার্ভিস আমি দেই। যদিও ভাইবোনেরাও মায়ের সেবাযত্নে আর্থিক বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক ৷ আমার মা এখন তাঁর জন্য রাখা আয়া বুয়াদের কাছে অত্যন্ত গর্ব এবং আবেগের সাথে আপন মনে স্মৃতিচারণ করেন। আমার জন্ম ইতিহাস বলেন, বারবার বলেন, বলতেই থাকেন । এমনকি, রাতে যখন আয়াকে বিশ্রামে দিয়ে আমি সারারাত মায়ের দেখাশুনা করি তখনও মা আমাকে বিড়বিড় করে আমার জন্ম ইতিহাস শুনাতে থাকেন।
শৈশব কৈশোরে যে কাহিনী বারংবার শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে আমার আত্মহত্যার প্রবনতা জেগেছিল আজ এই পরিপক্ক বয়সে সেই একই কাহিনী শুনে মায়ের প্রতি প্রচন্ড মায়া হচ্ছে ।
আত্মদহনের আগুনে সদাই জ্বলছেন আমার বৃদ্ধা মা।
আহারে আমার মা, আহা মা…
মানুষ তার অপরাধবোধের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্নভাবে নির্গত করে। মায়ের ভিতরে জমে থাকা অপরাধবোধ জীবনের এক এক পর্যায়ে এক এক প্রেক্ষাপটে এক একভাবে প্রকাশিত হয়েছে। শৈশব কৈশোরে মায়ের এই প্রকাশগুলোতে আমি কখনও কখনও প্রচন্ড মর্মবেদনা নিয়ে ভেবেছি, এই পৃথিবীতে আমি ভুল করে চলে এসেছি, আমি এ জগতের অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত একটি বস্তু মাত্র। ভুল দরজায় টোকা দিলাম কেন? কেন অন্যদের ঘরে ঢুকে পড়লাম?
এ আমার চরম অন্যায়।
কিন্তু আমার নিজস্ব ঠিকানা আসলে কোথায়?
হারিয়ে ফেলেছিলাম?
হারিয়ে গিয়েছিলাম?
কেন হারায়ে গেলাম?
এরজন্য কে দায়ী?
আমি না ঈশ্বর?
বোবা ঈশ্বর কথা বলেন না। শোনেন কিনা তাও আমার জানা নাই। হয়তো, তাঁর কাছেও আমি বোঝা হয়ে ছিলাম। তাই তিনিও আমাকে ছুড়ে ফেলে ভারমুক্ত হয়েছেন। কিন্তু, এ কোথায় ছুড়ে ফেললেন!!! যেখানে আমাকে কেউ চায় না। যেখানে আমাকে খুন করবার জন্য সবাই উদ্গ্রিব।
অথচ,
আজ এই বয়সে এসে বুঝতে পারছি, আহা, আমার মা, কতটা কষ্টই না পেয়েছেন সারাটা জীবন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে!!! তিনি সফল হন নাই তাতেই সারাটা জীবনভর এক মস্ত অপরাধবোধের ভারি বোঝা তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন। নিজেকে হালকা করবার জন্য কত বালখিল্য কাজই না করেছেন। কত ভাবেই না বারবার নিজেকে পুড়িয়েছেন, শাস্তি দিয়েছেন। তাও সে বোঝা এতটুকু হালকা হয় নাই। আজ মৃত্যুশয্যাতেও প্রায়শ্চিত্তের কী অদম্য, অবিরাম প্রয়াস।
আহারে আমার মা, আহা মা,,,
মা গত হয়েছেন প্রায়ই তিনবছরের বেশী। আসলেই আমি মায়ের এক হতভাগ্য, নিষ্ঠুরতম সন্তান। উঁনি বেঁচে থাকতে কখনও বলিনি, সজ্ঞানেই বলিনি, মা, তোমার মাতৃত্বের অলক্ষ্য ভালবাসাই আমার পৃথিবীতে আসবার একমাত্র যুদ্ধাস্ত্র ছিল। কিভাবে,কি দিয়ে তোমাকে বুঝাবো যে, তোমার আশ্রয়ের ঋণ শোধ করা যায় না।
কিন্তু মা, আমি তো একথাও তোমাকে কখনও বলিনি, বলতে পারিনি, পৃথিবীতে আসবার আগেই নিষ্পাপ আমাকে হত্যার প্রচেষ্টা এবং আমার শৈশব, কৈশোরে তোমারই দেয়া সেইসব অসহ্য যন্ত্রনাও ক্ষমাযোগ্য নয়।
হোক তা তোমার অপরাধবোধের বহিঃপ্রকাশ।
হোক তা তোমার আত্মদহন,,,
মা, আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারিনি, পারলাম না,,,