Homeগল্পবাকরুদ্ধ

বাকরুদ্ধ

বাকরুদ্ধ

টানা পাঁচ ঘণ্টা ক্লাস করার পর বিকেলবেলা বাসায় এসে হৃদয় জুড়ানো শান্তির একটা গোসল। তারপর একটা ঘুম। নাহ, সৃষ্টিকর্তা বোধহয় আমার ঘুমটা পছন্দ করেননি। আচমকা একটা ঝর তুলে দিলেন।বাতাসের তোড়ে দুপাশের দরজা দুটো ঢাস ঢাস করে শব্দ করতে লাগল। দু’মিনিটেই চারপাশের ব্যাপক পরিবর্তন। উনার চোখ শুধু দরিদ্র মানুষদের উপর।ঝরে দরিদ্র মানুষের খড়ের বাড়িসুদ্ধ উড়িয়ে নিয়ে যাবেন অথচ বড়লোকের উঁচু ফ্লাট যেন নিজ হাতে রক্ষা করবেন।যাক সে কথা। ঝড়ের সময় চা হলে মন্দ হয়না।অবশ্য সবার জন্য এই শর্ত প্রযোজ্য না শুধু আমি ছাড়া।বলতে পারেন সিম কোম্পানির শর্তের মত। ব্যাচেলরদের বেশিরভাগ কাজ নিজের হাতেই করতে হয়। চা’টাও তাই নিজের হাতেই করতে হবে। আর তাও দু’কাপ। বারান্দায় বসে আরও একজন ঝড় দেখেন। ওনাকে অনেকেই চেনে আবার অনেকেই ভুলে গেছে। ওনার নাম সিরাজ হায়দার। বড়ই আনরোমান্টিক আর খসখসে নাম। উনি নাকি একসময় মাত্র দুটি গল্প লিখেই সারাদেশে আলোড়ন তুলেছিলেন।

আচ্ছা লেখকদের নাম এতো খসখসে হয় কিকরে? তবে এখন উনি একজন অচেনা অতি সাধারণ চাকুরীজীবী। ওনার বিয়ের বয়সের এক্সপায়ার ডেট অনেক আগেই শেষ হয়ে গেলেও উনি এখনও ব্যচেলর। থাকেন আমাদের সাথে। আমার মাঝে মধ্যে লেখার ঝোঁক থাকায় ওনার প্রতি আমার আগ্রহটা ছিল একটু বেসি’ই। তবে কারও প্রতি আগ্রহ বেশি থাকলে সেটি তাকে জানাতে নেই তাতে তার কাছে নিজের দাম কমতে পারে। তাই ওনার সামনে গেলে আমিও একটু ভাবুক টাবুক সাজি। কারন ছাড়া আমি কারো প্রতি আগ্রহ দেখাই না, সে দেশের বড় নেতাই হোক আর পাড়ার পাউডার মাখা সুন্দরী হোক কারন না থাকলে আমার কাছে তাদের দুটাকাও দাম নেই।

বহুদিন সিরাজ ভাইয়ের কাছে একটা ঘটনা জানার জন্য ঘুরছি আর সেটা হল এতো বিখ্যাত আর জনপ্রিয় হবার পরও উনি কেন লেখালিখি ছাড়লেন? অবশ্য যেটা উনি পত্রিকা, নিউজ চ্যনেল থেকে শুরু করে নিজের কাছের বন্ধুকে বলেন নি সেটা আমাকে বলতে যাবেন কোন দুঃখে। তবুও আশা ছাড়া যাবেনা। বাঙালি বাচে আশায়। দুটো কাপ নিয়ে জেতেই একটা নিয়ে নিলেন। ওনার গায়ে সব সময় একটা শাল জড়ানো থাকে, কি গরম কি শীতে। মুখে খোঁচা খোঁচা আধাপাকা দাড়ি আর চোখে থাকে চশমা।ওজুর সময় ছাড়া ওই চশমা উনি খোলেন না। তার গম্ভির চোখ সামনে ঘটা কাল বোশেখের ঝরের অস্থিরতা অবলোকন করছেন। কথা বলা আমি’ই শুরু করলাম, “বুঝলাম বাতাসের মন খারাপ তাই সে ঝড় হয়ে অস্থিরতা দেখাচ্ছে কিন্তু লেখকের মন খারাপের কারন কি?” লেখক এবার মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “চা খাওয়ানোর কারন কি তাহলে এটা?” আমি এবার হাস্যজ্জল মুখটাকে ইচ্ছে করেই গম্ভীর বানিয়ে বললাম “থাক, জোড় করে কাউকে কিছু বলতে হবে না। আমরা তো আর বিখ্যাত কেউ নই”।

লেখক এবার একটু গললেন। এবার ঝরের অস্থিরতা একটু কম। লেখক সামনের দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “তুই কখনো প্রেমে পড়েছিস?” আমি ঈষৎ হেসে উত্তর দিলাম “প্রেমে তো অনেকের পড়েছি কিন্তু সবই প্রকাশ পাবার আগেই মুকুলেই ঝরে গেছে”। এবার লেখক বললেন তোর মত আমিও ভিরু ছিলাম। যদিও প্রেম ট্রেম আমাকে দিয়ে হবে না তা আমি আগে থেকেই জানতাম। তাই ওটা নিয়ে অত ভাবতামও না। আর কোন মেয়ে বোধহয় আমার চেহারা দেখে আমার প্রেমে পড়তে চায়নি। আমি এবার রহস্যের চোখ নিয়ে প্রশ্ন করলাম “একসময় পুরো দেশ নাড়িয়ে দেওয়া লেখক বলছেন যে তার প্রেমে কেউ কেউ পড়ে নি?” লেখক এবার বললেন তোর কথায় যুক্তি আছে। হ্যা,প্রথমদিকে পত্রিকায় লেখার সুবাদে আমাকে অনেকেই চিঠি পাঠাত সেগুলোতে কোনটা আমার প্রতি শ্রদ্ধা আর কোনটায় থাকত ভালবাসার। অবশ্য ভালবাসার মাত্রাটা বেশি’ই থাকত। তারপর যখন আমার প্রথম বইটা বেরুল তখন চারদিকে মোবাইল ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমার প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে আমার মোবাইলে প্রচুর ফোন আসা শুরু হয়েছিল।

জানিস সে সময় সাত টাকা মিনিট খরচ করে লোকে আমার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে চাইতো। সে সময় আমি ছিলাম টগবগে যুবক। এত তাড়াতাড়ি যে এভাবে নাম করব ভেবেই লজ্জা পাচ্ছিল। ওকারনেই বই মেলায়ও যেতাম না। আর এজন্যই পাঠকদের মনে আমাকে নিয়ে কৌতহল টা বেশি ছিল। সবচেয়ে বেশি যে নাম্বাটা বেশি কল দিত সে ছিল মেয়ে। আমাকে যারা কল দিত তাদের মধ্যে মেয়ের সংখ্যাই ছিল বেশি। তবে আমার এসব বিরক্ত লাগত। আমি চাইতাম কেউ আমার গুনের প্রেমে না পড়ে আমার প্রেমে পড়ুক। একটা মেয়ে প্রায়ই আমাকে কল দিত। শেষে বিরক্ত একদিন কলটা ধরলাম। তার আমার প্রতি অস্থিরতা ছিল আজকের এই কাল বৈশাখের মত। একটা পর একটা প্রশ্ন করেই চলছে আর আমি উত্তর দিয়েই চলছি। শেষে সে একটা আবদার করে বসল। সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। না, এটা ছিল অসম্ভব। যখন সবেমাত্র টুকটাক লেখালেখি শুরু করেছি তখন অনেকের সাথেই দেখা করেছিলাম।

কিন্তু একদিন এক ভক্তের সাথে দেখা করতে গিয়ে আমি এমন বিপদে পড়েছিলাম শেষে আমাকে সেখান থেকে পালাতে হয়েছিল। তখন থেকেই এসব একেবারেই বন্ধ। যাহোক মেয়েটাকে একেবারে না করে দিলাম। আমি প্রায়ই ভোরবেলা রস্তায় বেরুতাম। হালকা আলোতে ঢাকার বুকে সদ্য জন্মানো গাঁড় সূর্য দেখতাম। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাটতাম। টং দোকানে চা খেতাম। প্রকৃতি আমার কাছে নেশার মত। এই নেশা নাক দিয়ে মাথায় টেনে নিতাম তারপ বাসায় গিয়ে খচখচিয়ে কলম চালাতাম। এভাবে ভোরবেলা বেড়ানোর সময় একদিন এক টং দোকানে চা খাচ্ছিলাম। একটা মেয়েকে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকতে দেখতাম। তখন হালকা হালকা কুয়াশা পড়ত। মেয়েটা রিকশার জন্য অপেক্ষা করত। মেয়েটার কাধে একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকত। চুলগুলো মাঝেমাঝেই এলমেলো থাকত।ওর চুলের ভেতর শিশির জমত।মনেহয় রিক্সাটা রিজার্ভ ছিল। তাই মেয়েটাই প্রতিদিন ওই রিকশায় যেত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল রিক্সাওয়ালা ব্যাটা মাঝে মাঝেই দেরি করে আসত। তাতে আমার সুভিদাই হত। আমি ধীরে ধীরে মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। অচেনা একটা মেয়ের এভাবে প্রেমে পড়ে যাব ভাবতে পারিনি। 

অনেক দিন চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে সাহস করে কথা বলার। কিন্তু যখন’ই সাহস করে যেতে চেয়েছি তখন’ই হয়তো ওকে রিক্সা এসে নিয়ে যেত না হলে আমার যে কোন একটা জরুরী ফোন আসত। আসলে মধ্যম সারির সৎ লোকেরা কখনো সহস করে কোন কিছু বলতে পারে না। তাই সমাজ তাদের বোকা মনে করে। যাক সে কথা। আমার সেই মেয়ে পাঠকের কথা বলেছিলাম না তোকে?

আমি একটু মাথা চুলকিয়ে বললাম ও সেই ফাজিল মেয়েটা যে তোমাকে ফোন করে রোজ বিরক্ত করত। 

লেখক এবার মৃদু হেসে চায়ের কাপটা ব্যল্কুনির থাকে রেখে বললেন ”মেয়েটা আসলে আমার সব গল্প পড়ত। একেবারে পত্রিকার ছোট গল্প অবদি আমার লেখা বই পর্যন্ত। বলতে পারিস মেয়েটা আমার বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা আসলে, যিনি সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক তাকে প্রয়োজন ছাড়া মনে করিনা। অথচ যারা আমরা সেই মহান সাহিত্যেকের সৃষ্টি থেকেই সামান্য ধার করে লিখি তাদেরই কত ভক্ত। লেখকের কথার সাথে সুর টেনে আমি বললাম , বাঙ্গালিরা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কত ভালবাসে অথচ বাংলাদেশকে যদি তার সামান্য ভালবাসত তবে দেশটা সত্যিই আমেরিকা অথবা জাপান হত। লেখক এবার আমার পিঠ চাপড়ে বললেন ঠিক ধরেছিস। 

যা বলছিলাম,সেই পাঠক মেয়েটা আমাকে প্রতিদিন ফোন দিত। আমি বাধ্য হয়েই মাঝে মাঝে ধরতাম। ওর বোকা বোকা কথা শুনে মাঝে মাঝেই হাসতাম। এরপর আমার দ্বিতীয় বইটি প্রকাশ হল। মাঝে কিছুদিন লেখালেখির কারনে ভোরবেলা বেরুতে পারিনি। সেই মেয়েটার সাথে দেখাও হয় নি। ফোনটাও বন্ধ রেখেছিলাম লেখায় মনোযোগী হতে। যেদিন দ্বিতীয় বইটি বেরুল সেদিন’ই পাঠক মেয়েটা ফোন দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে জোরাজুরি করতে লাগল। শেষে বলল সে না’কি আর বেশিদিন পৃথিবীতে থাকবে না। আসলে তখন এতো ফোন আসত একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও মনে করেছিলাম মেয়েটা হয়তো দেখা করার জন্যই মিথ্যা বলছে তারপরও আমি পরদিন বিকেলে দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু একটা জরুরী কাজে আমাকে গ্রামে যেতে হল। তারপর মেয়েটা আর ফোন দেয় নি। আমি মেয়েটাকে ফোন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর মেয়েটাই ফোন দিল।আমি অবশ্য ফোন দিতে ভুলেই গিয়েছিলাম। যাহোক ফোন যখন দিয়েছে কথা বলি। কিন্তু ফোনে থাকা মেয়েটা জানাল ও পাঠক মেয়েটার ছোট বোন। ওর বোন কিছুক্ষন আগে মারা গেছে। ওর ক্যন্সার হয়েছিল। লাস্টস্টেজ চলছিল। যাবার আগে বলে গেছে ওর কবরে যেন আমি মাটি দিতে যাই। আসলেই রহস্যময় পৃথিবীর মানুষেরা আরও বেশি রহস্যময় হয়। তাদের বিস্ময়কর সব চাওয়া পাওয়া। খবরটা শোনার পর আমি ক্ষণিকের জন্য বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল। মেয়েটাকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছিলাম । কিন্তু ওকে আমি দেখে শেষবারের মত চমকে ছিলাম। এযে ভোরবেলায় দেখা আমার চিরচেনা সেই মেয়েটা। আমার বনলতা। এরপর আর কোনদিন আমি লিখতে পারিনি। কলম ছুতে পারিনি।

লেখক ঘটনাটা বলার সময় কখন যে অজান্তেই দুজনের চোখে জল চলে এসেছিল বুঝতেই পারিনি। এরপর লেখকের তৃতীয় ও শেষ বইটি বেড়িয়ে ছিল। না সেটা লেখক নিজে লিখেন নি। তার জীবনে ঘটা ঘটনাটাই আমি’ই লিখেছিলাম। কিন্তু তার শেষ বইটি তিনি দেখে যেতে পারেন নি।ওনার হার্টের অসুখ ছিল। এরপর আমার অনেক বই বেরিয়েছে কিন্তু লেখকের মত আমি আমার ফোন নাম্বারটি আর কাউকে দেবার সুযোগ করে দেই নি। কারন আমি আরেক জন সিরাজ হায়দার হতে চাই নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য