Homeপ্রবন্ধফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা

ফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা


.
বাংলা কবিতার ইতিহাস ঐতিহ্যের, নিরীক্ষার; বুদ্ধি ও কল্পনারও। পদাবলিী থেকে শুরু করে মাইকেলের যুগ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমানের কবিতা; সব যুগেই এই ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা প্রবহমান। ফলে উপস্থিতকালের কবিদের রচনায় অতীতের মহৎ ও প্রধান কবিদের ছায়া পড়ে। কখনো প্রচ্ছন্ন, কখনো প্রকটভাবে। তবে বিভিন্ন যুগের কবিতায় ঐকতান রক্ষা আকস্মিকভাবে ঘটে না, এ জন্য কবিদের বিপুল প্রস্তুতি ও অতীতের কবিতা আত্মস্থ করতে হয় উপস্থিতকালের কবিকে। ব্যত্যয়ে কেবল অনুকরণের ঘটনা-ই ঘটে, ঐতিহ্য রক্ষা হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক কবিতার দিকে তাকালে বিপুল প্রস্তুতি, পঠনপাঠন ও আত্মমগ্ন হওয়ার চেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত শব্দসমবায় সৃষ্টির প্রমাণ মেলে বেশি।
.
তাৎক্ষণিকতায় আক্রান্ত কবিযশপ্রার্থীদের সহজে বিজ্ঞপিত হওয়ার কাঙ্ক্ষা থাকে। এ কারণে তারা সাধনার অরণ্যে হাঁটে না, খোঁজে সংক্ষিপ্ত এবং তাৎক্ষণিকতার সংকীর্ণ পথ। এবং এই সংকীর্ণ পথ বেয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তারা নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়। এগুলো হলো;
.
১. ছন্দ উচ্ছেদের সচেতন প্রয়াস
২. গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
৩. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত শব্দসমবায় সৃষ্টি
৪. যৌনতার প্রাধান্য
৫. বিষয়হীনতা
.
এই প্রবণতাগুলো এ সময়ের প্রায় কবিযশপ্রার্থীর রচনায় উপস্থিত। এর পেছনে মূল কারণ হলো; কবিতা লিখিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ; নগদ হাততালি। এ সুযোগগুলো ঘটে দুইভাবে। প্রথমত ফেসবুক নির্ভর, দ্বিতীয়ত ব্লগ ও অনলাইনভিত্তিক কবিতাচর্চা। যাঁরা ন্যূনতম সাধনা ছাড়াই পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার স্বাদ পেতে চান, তাঁরা যে-েকোনো মুহূর্তের রচনাকেই ফেসবুকের নোটে কিংবা ব্লগে পোস্ট করতে পারেন। তাতে ফেসবুক বন্ধু এবং ব্লগারদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এসব প্রতিক্রিয়া সাধারণ ‘অসাধারণ’, ‘চমৎকার’, ‘বেশ হয়েছে’ ধরনের প্রশংসাসর্বস্ব হয়ে থাকে। আর এই নগদ হাততালিকে ফেসবুক-ব্লগার লেখকেরা শিল্পসিদ্ধির স্বীকৃতি ভেবে বছর না ঘুরতেই বই আকারে প্রকাশ করছেন। এসব বই আবার ফেসবুক বন্ধু-ব্লগাররা কিনছেন। তাতে হয়তো বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ উঠে আসছে, কিন্তু কবি, কবিতা ও পাঠকের তাতেই ক্ষতির মাত্রা বাড়ছে দিন দিন। ফেসবুক-ব্লগ কবিতাবিলাসীদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীপ্রীতি অন্য যে-কোনো মাধ্যমের চেয়ে বেশি; এবং ভয়াবহ। ফেসবুকে ও ব্লগকেন্দ্রিক একেক জন দাদা বা বড় ভাই বা গুরু থাকেন। তিনি যখন কোনো একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিধত স্ট্যাটাস পোস্ট করেন তাঁর ওয়ালে, তখন অনুসারীরা তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে কমেন্ট করতে থাকেন। কেউ যদি ওই দাদা বা গুরুর কমেন্টের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাহলে তাঁর অনুসারীরা তাঁকে তুলোধোধূনো করে ছাড়েন। এভাবে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করেন ফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক কবিরা। এসব কবির রচনার আদৌ কোনো শিল্পগুণ আছে কি না, তা পরিষ্কস্কার বোঝা যায় না। উদ্দেশ্যহীন ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাকচাতুর্যের সমবায়ে তাঁদের রচনার শারীরিক আকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফেসবুক বা ব্লগে কোনো সেন্সরশিপ না থাকায় ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগাররা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন। ফলে কোনো রকম নিয়ম-নীতি না মেনেই যা ইচ্ছা লিখে পোস্ট করেন। আর ওই পোস্টে একের পর লাইক-কমেন্ট পড়তে থাকে সমমনা ও অনুসারীদের। ওই লাইক-কমেন্টের সংখ্যাকে এসব কবি তাঁদের কবিতার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ভেবে বসে তৃপ্তি পান। এই তৃপ্তি কারও কারও জন্য আত্মশ্লাঘার কারণ হয়ে উঠলেও অধিকাংশই নিজের ভুল সহজে উপলব্ধি করতে পারে না।
.
ছন্দ কবিতা নয়, ছন্দহীন রচনাও কবিতা নয়। ছন্দ কবিতার একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ, যেমন মানবদেহে রক্তের চলাচল। কিন্তু ব্লগার বা ফেসবুক আসক্তরা দ্রুত বাহ্বা পান বলে ছন্দহীন রচনাকে যেমন কবিতা হিসেবে গ্রহণ করছেন, তেমনি ছন্দহীন প্রগলভতার চর্চায়ও উৎসাহী হয়ে উঠছেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের রচনার পাঠক, প্রকাশক নিজেরা হয়ে ওঠার ফলে কাব্যবোদ্ধাদের স্বীকৃতির বিষয়কে গৌণ করে দেখছেন তারা। তোয়াক্কা করছেন না সাহিত্যবোদ্ধা পাঠক-সমালোচকের মতামতের। নিজেদের রচনাকে নিজেরা স্বীকৃতি দিচ্ছেন, নিয়ম-কানুন কিছুই না জেনে। ছন্দ এবং কবিতার প্রকরণ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ ধারণা ছাড়াই ঘোষণা করছেন ছন্দ না মানার এবং প্রকরণ ভাঙার। এ শ্রেণীর কবিরা øবরি ও স্টান্টবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন সহজে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। একগোষ্ঠীর রচনাকে অন্য গোষ্ঠী করছেন অস্বীকার। আবার নিজেদের যেনতেন প্রকারেণ রচনা মাত্রকেই কবিতা-কবিতা বলে ঢেঁকুর তুলছেন হামেশাই। এই ভার্চুয়াল জগৎ সম্পূর্ণ অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পৃথিবীর যে-কোনো ঘটনা তাঁরা তাৎক্ষণিক জানার সুযোগ পান।
.
কোনো একজন প্রথম কোনো একটি বিশেষ ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে ব্লগ কিংবা ফেসবুকে পোস্ট করেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য ব্লগাররা কিংবা ফেসবুক বন্ধুরা ওই ঘটনা জানতে পারেন। এ ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত রচনার সাড়া মেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভার্চুয়াল জগতের কবিযশপ্রার্থীরা লিখে ফেলেন তাৎক্ষণিক কবিতা। ওই কবিতাগুলো সমকালীন বিষয়কেন্দ্রিক বলে এগুলোর এক ধরনের সংবাদ মূল্যও রয়েছে। ফলে যতটা না সাহিত্যমূল্য, তারও বেশি সংবাদমূল্য পায় অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে। এই অ্যাক্টিভিস্টরা নিজেরা নিজেদের যেনতেন প্রকারেণ রচনা নিয়ে তর্ক-কূটতর্কের অবতারণা করেন ভার্চুয়ালি, সে তর্ক-কূটতর্ককে তাঁরা ধরে নেন তাঁদের রচনার গ্রহণযোগ্যতা হিসেবে। ফলে মূলধারার সাহিত্যবোদ্ধাদের মতকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতেই দেখেন তাঁরা। ভার্চুয়াল জগতের অনেকের রচনা নির্দিষ্ট বিষয়হীন হলেও যৌনতার প্রাধান্য স্পষ্ট। মানুষকে আকৃষ্ট করার সহজতম পথ যৌনতা।
.
ব্লগার ও ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট কবিযশপ্রার্থীদের অনেকেই এই যৌনতাকেই কবিতাচর্চার মূল নিয়ামক ভেবে বসে আছেন; যৌক্তিক কারণও আছে। কারণ; মানুষের চিন্তার এক বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে যৌনচিন্তা। কবিতা কিংবা কোনো সৃজনশীল রচনায় যৌনতার প্রয়োগ থাকলে পাঠক তা সহজে গ্রহণ করে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ওই ধরনের রচনা তাঁদের ভালো লেগে যায়। এই শ্রেণীর কবিযশপ্রার্থীদের কর্মের চেয়ে আত্মম্ভরিতা বেশি। তাঁরা মূল ধারার সাহিত্য সম্পর্কে প্রায় নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এ কারণে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত কবিতা কিংবা প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতার প্রতি তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই। ভাবতে অবাক লাগে ভার্চুয়াল জগতের কবিদের অনেকেই হাজার বছরের বাংলা কবিতার উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কবির মাত্র দুটো কি তিনটি কবিতাও পড়ে দেখে না। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, মাইকেল, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের দুই- চারটা কবিতার নামও অনেকে জানেন না। বিষয়টা বিস্ময়ের যে তাঁরা কবিতা চর্চা করতে এসেও অগ্রজদের কবিতা পড়ে দেখেন না। তবে নিজেদের রচনার মান সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন তাঁরা। অথচ এ কথাও মানতে নারাজ তাঁরা; তাঁদের রচনার মান এখনো হাঁটুর ওপরে উঠতে পারেনি, প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত কবিতাগুলোর মান নামতে নামতেও হাঁটুর ওপরেই আছে।
.
ব্লগে-ফেসবুকে যাঁরা লেখেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের মনে করেন কর্তৃত্বকারী, তাঁরা অনুসারীদের নানা ধরনের রচনাকে জড়ো করে সংকলন প্রকাশ করেন। এসব সংকলন যেমন অজস্র বানান ভুলে ভরা থাকে, তেমনি থাকে ভুল বাক্য ও ভুল তথ্যের পাহাড়ও। এই প্রজাতির সংকলকেরা যেমন কবিতায় ছন্দকে স্বীকার করেন না, তেমনি ভাষার ব্যবহারেও ব্যাকরণ মান্য করেন না। যা লেখেন তা প্রকাশ করাকেই জীবনের সিদ্ধি জানেন। এসব লেখা পড়লে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, এই প্রজাতির লেখক-সংকলকেরা যেন মাতৃভাষাকে ধর্ষণ করার ব্রত নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে এসেছেন। ফলে যেমন খুশি লিখছেন। যেহেতু সংকলক এবং ব্লগের অ্যাএডমিনরা কোনো পঠনপাঠন কিংবা নিয়ম কানুনের ধার ধারেন না, সেহেতু নিজেদের অনুসারী কিংবা পছন্দের লোকদের যা পান তাই পত্রস্থ কিংবা পোস্ট করেন। সম্পাদনার নিয়ম-কানুনও তাঁদের মানতে হয় না। অবশ্যই বর্তমানে অনেক দৈনিকলগ্ন সাহিত্যপাতার দায়িত্বপ্রাপ্তরাও সম্পাদনার ধার ধারেন না। তাঁরা খ্যাতিমান লেখক, প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের অখাদ্য-কুখাদ্য পেলেই শুধু যে-কোনো দিক থেকে শব্দ সংখ্যা কমিয়ে পত্রস্থ করতে পারলেই চাকরিজীবন সার্থক মানেন। আর এসব ব্লগে যাঁদের লেখা পোস্ট হয়, তাঁরা এত বেশি আবেগে উদ্বেল থাকেন যে, একই রচনা একই সঙ্গে একাধিক ব্লগে পাঠানোর ভেতর আত্মতৃপ্তি খোঁজেন। কবিতার অনেক শত্রুর মধ্যে এই ব্লগ-ফেসবুক প্রভাবশালী মাধ্যম। দুর্বল লেখকের হাতে পড়লে যৌনতা যেমন পর্নোগ্রাফিতে পর্যবসিত হয়, তেমনি অপ্রস্তুত ব্লগারদের হাতে পড়ে বাংলা কবিতাও আজ খিস্তি-খেউড়ে পরিণত হয়েছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য