বাদশা ওয়াজেদ আলী
সকাল থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আশ্বিন মাসের এ সময়টাতে অসহনীয় গরম থাকে। প্রবল বর্ষণ না হলেও, অল্পবিস্তর বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি দেয়। অরূপের দাদি সুরমা বিবি ঘর থেকে আজ বের হতেই পারেনি। বৃষ্টির পানিতে সারা ঘর সয়লাব। ঘরের ভিতরে কোথাও মাটির সানকি, রঙের কৌটা, সিলভারের কড়াই বিভিন্ন পজিশনে দেওয়া হয়েছে। যাতে বিছানার জায়গাটা অন্তত শুকনো থাকে। সেটা সম্ভব হয়নি। ঘরের উপরের পলিথিন অনেক পুরোনো। পচে গিয়ে খসে পড়েছে। একটা বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে চোখের ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে স্মৃতি হাতড়িয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে ‘অরূপ’ ‘ও অরূপ’ বলে ডাকাডাকি করছে। আজ প্রায় দুই দিন হলো সুরমা বিবি ভিক্ষা করতে বের হতে পারেনি। চুলো পানিতে ভরে গেছে। রান্না হয় না।
নবাব ওরফে নবা অরূপের পিতা। ২০২০ সাল। চারদিকে করোনার দাপট। সরকার ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। নবাব বিরাটখালি বাজারের ঝাড়ুদার। বাজারের দোকানপাট বন্ধ। নবাবের আয়ের পথও বন্ধ। সরকারি সাহায্যের হাত নবাবের কাছে পৌঁছেনি। বাজারে ধানকলের মেঝেতে পড়ে থাকা চাল ময়দা কুড়িয়ে দু-এক দিন সংসার চলে যেত। এখন সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকজন কম আসে। ধানকলের মালিক একদিন নবাবকে বলল,
—নবা, ও নবা, আমার কথাডা মন দিয়ে শোন।
—কন দেকিনি জহর চাচা। এই নবা হলোগে আপনাগের গুলাম। আমি শুনতেছি।
—নবা, দ্যাশে আকাল নাগেছে। বেচা-বিক্রি নেই। আমাগেরও তো গরিপ গুরোপ আত্মীয়স্বজন আছে। উরা এইডা কুড়ায়ে নেবে। তুই তো ম্যালা দিন খাইচিস। একন বাদ দে।
—হ, বুজিচি। নবাব গামছায় বাঁধা বালি, কাঁকর মিশ্রিত চালগুলো পাকা মেঝেতে ঢেলে রেখে মাথা নিচু করে কলঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শূন্যহাতে নবাব বাড়ি ফিরতে পারেনি। শিশুসন্তান অরূপকে আজ কী খেতে দিবে। বাড়িতে রান্না হবে না। বিরাটখালি গ্রামের একদম দক্ষিণে নবাবের কুঁড়েঘর। ঘরে নবাবের মা আর শিশুপুত্র অরূপ থাকে। অরূপের জন্মের সময় খিঁচুনি রোগে অরূপের মায়ের মৃত্যু হয়। দাদি হয়ে পড়ে একমাত্র অবলম্বন।
বিরাটখালি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কুমার নদী। স্রোতহীন। কচুরিপানায় দুই কূল ঘিরে ধরেছে। নবাব নদীর ধারটায় বটগাছের শেকড়ের ওপর বসে পড়ল। এ পথে এখন লোকজন খুব কম চলাচল করে। দূরে মোল্লাবাড়ির কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। নবাব শুনেছে বড় মোল্লা সাহেব কুকুরের জন্য অনেক খরচ করে। গোশ রান্না হয়। মাছ রান্না হয়। শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো হয়। কুকুরের কোনো দুঃখ নেই। অভাব অনটন নেই। নবাব নিজেই একবার বেশ জোরে ‘ঘেউ’ করে উঠল। বটগাছের পাতার মধ্যে পাখিগুলো ভয় পেয়ে নড়েচড়ে বসল। নবাব চোখ বন্ধ করে আছে। রান্না করা মাছ গোশের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিল। এখন ভালো লাগছে। নবাব উঠে দাঁড়াল। অন্ধকার আকাশে হাজার হাজার তারা। ওরা আকাশকে ভাগাভাগি করে বাস করছে। কোনো বিভেদ নবাবের চোখে ধরা পড়ল না। ওখানে চালকলের মালিক নেই। ওদের একটাই কাজ। আলো দাও। পৃথিবী সুন্দর হোক। নবাব ঐ তারকাদের দেশে একটা উজ্জ্বল তারা হয়ে বেঁচে থাকতে চায়। ওখান থেকেই অরূপের ওপর ভালোবাসার আলো ঝরাতে চায়।
নবাব বাড়ি ফিরে যায়নি। ফিরতে পারেনি। অভুক্ত অরূপের মুখখানা সে কীভাবে দেখবে। নবাব রাতের অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অরূপের মায়াময় মুখখানা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল।
অরূপের খেয়ে অথবা না খেয়ে দিন কাটে। দাদি সুরমা বিবি চোখে কম দেখে। একটা লাঠির প্রান্ত ধরে অরূপ এগিয়ে নিয়ে যায় এ-বাড়ি সে-বাড়ি। দিন শেষে সেই নড়বড়ে ফুটো চালার ঘরে ফিরে আসে। কোনোদিন রান্না হয়, কোনোদিন হয় না। পিতৃহীন সাত বছরের অরূপ নিয়তিকে মেনে নেয়।
সপ্তাহখানেক আগে দক্ষিণপাড়ার জলিল মাতবরের নাতির মুসলমানি হলো। অরূপ দাদিকে নিয়ে বাড়ির উঠানে বসে আছে। হাজাম এসেছে। মাথায় জিন্না ক্যাপ। হাসি হাসি মুখ। রান্নাঘর থেকে মাংস রান্নার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। মুসলমানির কাজ শেষ। হাজামের জন্য পাটি পেতে বসতে দেওয়া হয়েছে। খাবার আনা হলো। মুরগির মাংস। একটা বড় প্লেটে রুই মাছের মাথা ভুনা। হাজাম এবার ভুনা মাছের মাথাটা হাত দিয়ে ভেঙে মুখের মধ্যে পুরে দিচ্ছে। অরূপ আর একটু এগিয়ে গেল। পূর্বের অবস্থান থেকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। হাজাম বেশ ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। মাথার ঘিলু বের করার জন্য জোরে চুষতে থাকল। অরূপ মনের অজান্তে কায়দাটা রপ্ত করে নিচ্ছে। হাজামের খাওয়ার শেষ অবধি অরূপ দাদির পাশে বসে থাকল। একটা খালি প্লেটে মাছ গোশের হাড়গোড় ডাই হয়ে জমে আছে। মাতবরের বড় ছেলে সেই প্লেটটা হাতে নিতেই অরূপ উঠে দাঁড়াল। লোকটা বড়ির পোষা কুকুরকে সবগুলো ঢেলে দিল। কুকুরের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বা সাহস অরূপের নেই।
অভুক্ত থেকেই অন্য বাড়ির পথ ধরল ওরা। অরূপ ভাবে, হাজামের ব্যবসাটা শিখতে পারলে কষ্ট থাকত না। বড় রুই মাছের মাথা খাওয়া যেত। কিন্তু, কে তাকে শিষ্য বানাবে?
বিরাটখালি বড় মসজিদে সেদিন মিলাদের আয়োজন। রান্না হয়েছে। বিকালে আসর নামাজের পর জিকির। বিকালে ভাত, গরুর গোশ এবং শেষে মিষ্টি। অরূপ মসজিদের বারান্দার পিলার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মুয়াজ্জিন অরূপকে দেখে কাছে ডাকল। মুখে পবিত্র হাসি নিয়ে অরূপে মাথার ওপর স্নেহের হাত রাখল।
—তুমি নবার ছাওয়াল না? কী সোন্দর আলহামদুলিল্লাহ। হাকিমপুরি জর্দার ঘ্রাণে অরূপের ভাতের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেল।—তুমি তো মুতে পানি নেওনি। তোমার কাপড় অপবিত্র। আগে পবিত্র হও। আল্লাহ কবুল করবে। একন চলে যাও, বাছা। মুরুব্বিরা খাবে। অরূপ পবিত্রতার রূপে কবে ডুব দিবে জানে না। অরূপের মুয়াজ্জিন হওয়ার ইচ্ছা জাগে। খাওয়ার অভাব নেই। ক্ষুধার কষ্ট নেই।
বিরাটখালি গ্রামের উত্তরে হিন্দুপাড়া। ইসকনের নতুন মন্দির হয়েছে। মাথার পেছনের দিকে টিকি রাখা আর তিলক আঁকা কিছু মানুষ এখানে ভিড় করে। সন্ধেবেলায় ভক্তিগীতির পরে প্রসাদ বিতরণ হয়। অরূপ দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। একজন বয়স্ক টিকিধারী অরূপকে দেখে বলল,
—হরিবল, তুমি মুচলমান না? নবার ছেলে?
—আমি অরূপ। আমার বড় খিদে নেগেচে।
—তুমি তো আমাদের গোপাল। ওরে অরূপ, স্বামীজির শিকাগোর ভাষণ তো শুনিস নি? অন্য ধর্মের মানুষ আমাদের দরকার। রাখাল দাস নামের কাউকে সে বলল—অরূপের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেও। নামাবলি দিয়ে একটা ছবি তোলো। ইউটিউব ভিডিওর নিচে লিখে দাও—একজন মুসলমান বালকের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ।
ফটো তোলা হলো। সবার মধ্যে ঐশ্বরিক চেতনা ছড়িয়ে পড়ল। অন্তত একজন মানুষকে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনা গেল। সবাই গদগদ হয়ে উদ্বাহু তুলে সুর করে গাইতে লাগল—হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, হরে হরে। অরূপের দিকে কেউ তাকাল না। তাদের মধ্যে ঈশ্বর মহিমায় অচৈতন্য ভাবের উদয় হলো। অচৈতন্যের ভাবনায় অরূপের ক্ষুধা মিটল না। অরূপ নামাবলিটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরল। অরূপ যদি ঐ বয়স্ক সন্ন্যাসীর মতো হতে পারত, তাহলে ক্ষুধার কোনো কষ্ট থাকত না। তার হাতে ছিল ফলমূলের থালা। তার হুকুমে সবাই প্রসাদ পায়।
অরূপ এ কয়দিন খেতে পায়নি। শুধু পানি আর দাদির ভিক্ষে করা চাল চাবিয়ে খেয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজেছে। শুকনো মুখখানা আরও মলিন হয়েছে। কাশি হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে দুপুর থেকেই। কিছুই ভালো লাগছে না।
—ভাই, তোর গা যে পুড়ে যাচ্ছে? জ্বর আয়েচে। একন আমি কী করি? অরূপের দাদির কান্নার রোল কেউ শুনতে পেল না। বৃষ্টির দমকা বাড়ছে। অরূপ বৃষ্টি পানিতে ভেজা ঘরের একপাশে শুয়ে কোঁকাচ্ছে। অরূপের দাদি বিরাটখালি বাজারে কালাম ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল ওষুধ আনতে।
—ও, জ্বর আয়েচে? ঠিক হয়ে যাবিনি। কাছে টাকাকড়ি কিছু আচে?
—দলকের (বৃষ্টির) জন্যি বেড়াতি পারিনি, ডাক্তার। আমি তুমার পয়সা দেবনে। একন ওসোদ দেও।
—ক্যামনে দেব? আমি কি লাটসায়েব? সকাল হলি জ্বর থাকপি নানে।
খালি হাতে ফিরে এলো সুরমা বিবি। ভোরের অপেক্ষায় থাকল সে। মধ্য রাত্রিতে অরূপ জ্বরের ঘোরে এলোমেলো কথা বলছে। স্বপ্ন দেখছে। বিরাটখালি বাজারে রং-বেরঙের দোকান। দোকানের সামনে রাখা খাবার উপচে পড়ছে। হাজাম কাকা অরূপকে ডাকছে। মসজিদের মুয়াজ্জিন ডাকছে। টিকিধারী তিলক দেওয়া হিন্দু সন্ন্যাসী ডাকছে।—অরূপ, আমাদের কাছে আসো। সব খাবার তোমার জন্য।
—আমার যে আর খিদে নেই গো। তোমাগের ধম্ম তো আমি বুজিনি। আমার বাপ, আমার দাদি, কেউ বোজে না। সকাল হলি আমার দাদির হাত ধরে দূরির ঐ গিরামে চলে যাবনে। আমারে একন ছাড়ে দেও।
ভোরের দিকে বৃষ্টি থেমেছে। দক্ষিণপাড়ার মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। সূর্যের লাল আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। অরূপের প্রলাপ বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। সুরমা বিবি অরূপের হিমশীতল শরীরে হাত দিয়ে সব বুঝে নিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—বাপের কাছে ভালো থাকিস। https://www.banglatribune.com/literature/short-stories/834464/%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B6-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9D%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B2-%E0%A6%9B%E0%A7%8B%E0%A6%9F-%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A6%BF%C2%A0