রোল্ড ডাহল
ছাতাবাবু
নিলয় বরণ সোম
মূল গল্প : The Umbrella Man লেখক: Roald Dahl অনুবাদ : নিলয় বরণ সোম
[ পূর্বকথাঃ এই গল্পটি লেখকের More Tales of the Unexpected গ্রন্থ থেকে নেওয়া । এই অনুবাদকর্মটি নেহাতই মানুষের , বিশেষত ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য এবং এর কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই , এবং ভবিষ্যতেও কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লেখক সজ্ঞানে এটি ব্যবহার করবেন না বা ব্যবহার করার অনুমতি দেবেন না , সুতরাং এটি আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র কপিরাইট আইনে উল্লেখিত ‘Fair Use’ এর মধ্যে পড়ে ও কপিরাইট লঙ্ঘনের কোন প্রশ্ন এখানে নেই। আক্ষরিক অনুবাদ না করলেও, গল্পটির বিদেশী আবহ বজায় রাখা হয়েছে – বিনীত অনুবাদক। ]
গতকাল সন্ধ্যাবেলা আমার আর মায়ের সঙ্গে যে মজার ঘটনাটা ঘটেছে সেটাই বলতে বসেছি । আমার বয়স মাত্র বারো হলেও লম্বায় প্রায় মায়ের মত ,দূর থেকে আমাদের তাই লোকে মা মেয়ে না ভেবে দুই বোন ভাবে ।
কাল বিকেলে মা আমাকে এক ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে গেছিল। যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু বলে দিলেন, আমার একটা দাঁতে ক্যাভিটি আছে । পোকায় খাওয়া দাঁতটা উনি ফিল আপ করে দিলেন, ভাগ্য ভাল , খুব ব্যাথা লাগে নি আমার । এরপর মায়ে বেটিতে মিলে একটা ক্যাফেতে গেলাম, আমি নিলাম একটা ব্যানানা স্প্লিট আর মা নিল শুধু কফি । ক্যাফে থেকে বেরোতে বেরোতে ছ’টা বেজে গেল ।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি পড়ছে । মা বলল, ” একটা ট্যাক্সি নিতেই হবে !” ডেন্টিস্টের কাছে তো আর আমরা খুব সেজেগুজে করে যাই নি, সাধারণ কোট আর হ্যাট পরেই গেছিলাম , জবরজং পোশাক গায়ে না থাকলেও বৃষ্টিতে চলতে কিন্তু অসুবিধেই হচ্ছিল ।
“চলো, আমরা ক্যাফেতে ফিরে যাই , বৃষ্টি থামলে বেরোন যাবে । আমার আসলে ধান্দা ছিল আরেকটা ব্যানানা স্লিট সাঁটানো , বড্ড ভাল ছিল ওটা । “
মায়ের কোন উৎসাহ দেখলাম না । মা বলল , ” এই বৃষ্টি সহজে থামার নয় । যত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে পারি, তত ভাল । “বৃষ্টির মধ্যে আমরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির দিকে চোখ রাখছিলাম । যাচ্ছিলও ক’টা ,কিন্তু সব যাত্রীবোঝাই । মা আস্তে করে শুধু বলল , ” আমাদের যদি গাড়ি আর ড্রাইভার থাকত , তবে এই অসুবিধায় পড়তে হত না ।
ঠিক সেই সময় আমাদের সামনে এক বুড়ো ভদ্রলোক এসে হাজির । দেখতে ছোটখাট ভদ্রলোকটির বয়স প্রায় সত্তর তো হবেই । মাথার টুপিটা একটু খুলে মায়ের উদ্দেশ্যে উনি বললেন , ” এক্সকুইজ মি ,আপনার থেকে খুব সামান্য একটা সাহায্য চাইছি, আশা করি নিরাশ করবেন না !”
বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে মা বলল, ” বলুন !”
” যা বললাম আপনার থেকে একটা ছোট সাহায্য চাই, এইটুকু সাহায্য !”
দেখলাম, মা ভদ্রলোকের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার মায়ের এমনিতে একটু সন্দেহ বাতিক আছে । দুটো জিনিসের উপর মায়ের সন্দেহ সবথেকে বেশি এক হচ্ছে অচেনা লোক আর দুই হচ্ছে ডিম্ সেদ্ধ । সেদ্ধ ডিমের ওপরটা ছুরি দিয়ে কাটার পর মাকে দেখি চামচ দিয়ে একটু খোঁচাতে , যেন ভিতরে ছুঁচো বা ইঁদুর আছে কিনা দেখছে !
আর অচেনা লোকের ব্যাপারে মায়ের তো একটা বিখ্যাত থিওরি আছে , ” অচেনা লোক কে বেশি ভদ্রতা করতে দেখলে তাকে সন্দেহ করবি আরো বেশি !” এই বেঁটেখাটো বুড়ো লোকটি কিন্তু খুব ভদ্র । কথা বার্তায় মার্জিত , পোশাকও ফিটফাট । পাক্কা ভদ্রলোক বলা যায় ওঁকে , বিশেষ করে ওঁর জুতোর দিকে তাকিয়ে আমার এই কোথায় মনে হল । বলতে গেলে এই থিওরিও আমার মায়ের কল্যানে জানা ,” কোনো পুরুষ ভদ্রলোক কিনা বোঝা যায় তার জুতোর দিকে তাকালে !”
এই ভদ্রলোক এক জোড়া সুন্দর বাদামী জুতো পরেছিলেন ।
এবার উনি আবার শুরু করলেন , “ ব্যাপারটা হল, আমি একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি, তাই একটু সাহায্য চাই । আপনার কাছে সেটা কিছুই না কিন্তু আমার কাছেবিরাট কিছু । জানেনই তো, আমাদের মত বয়সের অর্ধেক বুড়ো মানুষরা ভুলোমনা আর এই ভুলো মনের জন্যই আজকে বিপত্তি । “
দেখলাম ,মা মাথা উঁচু করে লোকটির দিকে একদৃষ্টে দেখছে । এই জিনিসটা কিন্তু খুব চাপের । মায়ের এই তাকানোর সামনে বাঘা বাঘা লোক ঘায়েল হয়ে যায়। একবার মায়ের এই দৃষ্টির সামনে আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার মশাইকে ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে, তোতলাতে দেখেছি । কিন্তু ছাতি বুড়োর দেখলাম হেলদোল নেই । একটু হেসে মাকে বললেন, “বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, রাস্তাঘাটে মহিলাদের থামিয়ে দুঃখের গল্প ফাঁদার লোক আমি নই । “
মা জবাব দিল , ” সেটাই তো বাঞ্ছনীয় । “
মায়ের এই সোজা সাপ্টা কথায় আমার বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মা কে বলি, “মা মনি , এই সুইট দাদু নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছে , ওর সঙ্গে অভদ্র হয়ো না প্লিজ । ” মনের কথা আমাকে মুখেই রয়ে গেল , কিছু বলতে পারলাম না আমি ।
বুড়ো মানুষটা হাতের ছাতাটা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিলেন,, “ এর আগে কখনো এমন ভুল হয়নি আমার । “
“কী ভুল হয়েছে আপনার ?”,মা বলল ।
-“ওয়ালেট ফেলে এসেছি । নিশ্চয়ই আমি আমার অন্য জ্যাকেটটার ভিতর এটাকে ঢুকিয়ে রেখেছি -পুরো ব্যাপারটা কেমন বোকা বোকা না ?”
মা বললো , “তাহলে ব্যাপারটা হচ্ছে আপনাকে কিছু পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে হবে, তাই তো ?”
ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন , : “ওহ না, এরকম দয়া ভিক্ষা যেন আমাকে জন্মেও না করতে হয় !”
মা এবার বলল, : “তাহলে আপনার চাই কী ? দেখুন, এরকম করে বৃষ্টিতে ভিজতে আমাদের একটুও ভাল লাগছে না,আমি জানি সেটা। সেজন্যই আমি বলছি, আপনি আমার ছাতা নিন, আর একেবারেই নিয়ে নিন, কিন্তু তার জন্য,,”
-“কিন্তু তার জন্য কী ?”
– ” এর বদলে আপনি যদি আমাকে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার জন্য এক পাউড দেন,!”
মায়ের সন্দেহ গেল না । “প্রথম থেকেই আপনার পকেট যদি ঢুঁ ঢুঁ ; করে, আপনি এতদূর এলেন কী করে ?”
উনি জবাব দিলেন ” আমি হেঁটে এলাম। প্রত্যেক দিন আমি হেঁটে হেঁটে কোথায় চলে যাই আর ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি ফিরে আসি । “
-“তাহলে এখন আপনি হেঁটে যাচ্ছেন না কেন ? “
-“পারলে তো ভালই হত , কিন্তু এই বুড়ো বয়সে আমি আর সেটা পারবো না ।আজ অনেক হেঁটে ফেলেছি “
মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগলেন । বুঝতে পারলাম, মা একটু গলে গেছে। আর এসময় একটা ছাতা পাওয়া গেলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না,এটাও মায়ের মাথায় খেলেছে ।
বুড়ো মানুষটি বললেন, ” দারুন কিন্তু ছাতাটা !”
-“লক্ষ্য করেছি,:” মায়ের সংক্ষিপ্ত জবাব ।
-” এটা কিন্তু সিল্ক “
-” দেখেছি সেটা “
-“তাহলে ম্যাডাম আপনি নেবেন না কেন? এটার দাম ছিল ২০পাউন্ড । কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোন গুরুত্ব আমার কাছে নেই , আমি শুধু বাড়ি ফিরতে চাই।”
দেখলাম মায়ের হাত বটুয়ার দড়ির দিকে যাচ্ছে । আমি যে মাকে দেখছি এটা আবার মা টেরিয়ে টেরিয়ে লক্ষ্য করছিল । এবার আমি আমার স্পেশ্যাল চাউনিটা মাকে দিলাম । মনে মনে বললাম, ” দোহাই মা, এই বিপদে পড়া বুড়োটার বিপদের সুযোগটা নিও না, আর যাই করো !”আমি জানি , আমি কি বলছি মা ঠিক বুঝতে পেরেছে । মা একটু থিম আবার আমার দিকে তাকাল ।
বুড়ো ভদ্রলোককে মা বলল এবার, ” আমার মনে হয় আপনাকে এক পাউন্ড দিয়ে ওই ২০পাউন্ডের ছাতাটা নেওয়া ঠিক কাজ হবে । আপনাকে আমি ট্যাক্সি ভাড়ার টাকাটাই দিচ্ছি !”
এবার বুড়ো ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন , ” না না ,কিছুতেই না ম্যাডাম ! আমার প্রাণ থাকতে আপনার থেকে এমনিতে টাকা নিতে আমি পারবো না । ছাতাটা নিয়ে বৃষ্টি থেকে আপনি বাঁচুন, বাচ্চা মেয়েটিকেও বাঁচান !”
মা আমার দিকে তেরছা মত তাকিয়ে একটা বিজয়ী বিজয়ী ভাব দেখালেন । বাছা ভুল তোমার, উনিই ছাতা নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছেন !
মা এবার বটুয়ার থেকে এক পাউন্ডের একটা নোট বের করল । ভদ্রলোক টাকাটা নিয়ে মায়ের হাতে ছাতাটা তুলে দিলেন । টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে , টুপিটা একটু তুললেন , একটু ঝুঁকে মাকে বললেন , “থ্যাংক ইউ , ম্যাডাম,”থ্যাংক ইউ !”
” এবার ছাতার নীচে চলে আয় । মা বলল, ” আমরা সত্যি লাকি । একটা সিল্কের ছাতা কেনার সামর্থ্য নেই আমার , দ্যাখ, সেটাও জুটে গেলো!
” প্রথমে তুমি ওঁর সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করছিলে কেন ?” -” আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম লোকটা ঠগ কিনা । না রে , জেন্টলম্যান যাকে বলে,- ওঁকে সাহায্য করতে পেরে ভালোই লাগছে । “
-“হ্যাঁ মা, আমিও একমত । “
-“পাক্কা ভদ্রলোক – পয়সাকড়িও আছে , না হলে সিল্কের ছাতা নিয়ে ঘুরত না । আমি অবাক হবে না যদি উনি নাইট গোছের কেউ হন -স্যার হ্যারি গডসওয়ার্থ বা সেরকম একটা কিছু । “
-” হ্যাঁ মা “
মা লেকচার দিতে থাকেন , ” তোমার এটা একটা ভাল শিক্ষা হল । কাউকে চটজলদি বিচার করতে নেই , সময় নিয়ে তারপর তোমার সিদ্ধান্ত নিও । তা হলে জীবনে আর ভুল করবে না । “
-“ওই দেখ ,উনি যাচ্ছেন,” আমি বললাম ।
-“কোথায় ?”
-” ওই দেখ , রাস্তা পার হচ্ছেন – বাব্বা, কী তাড়াহুড়াই না করছেন !”
দুজনেই দেখলাম , ভদ্রলোক বেশ ট্রাফিক ডজ করে রাস্তা পারলেন, তারপর খুব তাড়াতাড়ি বাঁয়ে মোড় নিলেন ।
-“মা ভদ্রলোককে খুব টায়ার্ড তো লাগছে না !”
মা উত্তর করলেন না ।
-“মা, উনি ট্যাক্সি খুঁজছেন বলে তো মনে হচ্ছে না !” মা পাথরের মত দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপারে নজর করছিল । এবার ওঁকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল । জোর কদমে ফুটপাথ দিয়ে অন্য পথচারীদেড় পাশ কাটিয়ে মার্চ করতে করতে চলেছেন ।
মায়ের মুখটা দেখলাম থমথমে । “কিছু একটা করতে চলেছেন উনি “-অবশেষে মা মুখ খুললো ।
-কী মা ?”
-” সে আমি কী জানি !”
কিন্তু আমি সেটা বের করবোই-যায় আমার সাথে । “
আমার দুজনে রাস্তা পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিলাম ।
-” তুমি ওঁকে দেখতে পাচ্ছ ?”
-হ্যাঁ , ডানদিকে পরের গলিটাতে গেল দেখছি । “
কোনায় এসে আমরা আবার ডাইনে বাঁক নিলাম । বুড়ো এবার আমাদের থেকে কুড়ি গজ মত এগিয়ে । ওঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে আমাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল । ততক্ষনে বৃষ্টির তোড় আরো বেড়ে গেছে আর দেখলাম বৃষ্টির ছাঁট ওঁর হ্যাট বেয়ে কাঁধের উপর পড়ছে , আর ওঁর ছাতা মাথায় নিয়ে আমরা দিব্যি শুকনো মাথায় হাঁটছি ।
-“উনি যাচ্ছেনটা কোথায় ?”মা বললো ।
আমি বললাম, “যদি ঘাড় ঘুরিয়ে উনি আমাদের দেখে ফেলেন !”
-“আমার বয়েই গেছে । উনি আমাদের মিথ্যা কথা বলেছেন -আমাদের বললেন. ক্লান্ত শরীরে উনি আর হাঁটতে পারছেন না !আর এখন আমাদের ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছেন ! ও একটা ঠগ, জোচ্চোর – মা উনি থেকে ‘ও ; তে নেমে গেল ।
-মা ,তারমানে উনি নাইট টাইট কিছু নন !”
-“চুপ করবি এবার ?”
পরের ক্রসিংয়ে বুড়ো আবার ডান দিক নিল , তারপর বাঁ , তারপর আবার ডান ।
_আমি হাল ছাড়ছি না !,মা জোরে জোরে বললো ।
-মা কিন্তু ওকে তো আর দেখছি না -কোথায় গেল !
ওই তো , ওই বাড়িটাতে ঢুকল দেখলাম ! মাই গুডনেস !ওটা একটা বার !”
আমিও দেখলাম, বড় বড় অক্ষরে নিয়ন আলোয় লেখা রয়েছে , “দ্য রেড লায়ন । “
– তুমি ভেতরে যাবে না তো মা , তাই না ?”
“না, বাইরে থেকে দেখব কিছুক্ষন । ” বারের সামনের দিকে বেশ বড় কাঁচের জানালা । ভেতরটা একটু ধোঁয়াটে হলেও আমরা মোটামুটি দেখতে পারছিলাম ।
বারের জানালার ধারে আমরা চুপচাপ ঠেসে দাঁড়িয়ে ছিলাম , আমি মায়ের গা ঘেঁষে । বৃষ্টির ফোঁটাগুলি ছাতার উপর শব্দ করে পড়ছিল । মা কে বললাম , ” দেখ , ওই যে, ওই !”
লোকভর্তি ঘরটা সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল ,আর আমাদের ছোটখাট হিরো ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে । ওঁর মাথায় এখন হ্যাট বা গায়ে কোট নেই , ভিড় ঠেলে উনি কাউন্টারের সামনে যাচ্ছেন । বারম্যানের সঙ্গে ওঁকে কথা বলতে দেখা গেল, বেশ ঘনিষ্ঠভাবে । বারম্যান একটু ঘুরে এসে ওঁর হাতে সোনালী তরল ভরা পানপাত্র ধরিয়ে দিল, উনি এক পাউন্ডের নোটটি কাউন্টারে দিলেন ।
মা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ” আমার এক পাউন্ড ! লোকটার দম আছে বটে !”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” গ্লাসে কী আছে ?”,
– ” হুইস্কি , নীট হুইস্কি , সোডা ফোড়া কিচ্ছু নেয় নি ! শুধু তাই না রে , মনে হচ্ছে ট্রেবল হুইস্কি নিয়েছে !
-“সেটা আবার কি ?
-সাধারন মাপের তিন গুণ !”
ছোটখাট মানুষটি হুইস্কির গ্লাসটি ঠোঁটে ছোঁয়ালেন , তারপর হাতে করে গ্লাসটি একটু তুলে ধরলেন, তারপর আরেকটু, তারপর আরেকটু , তারপর এক ঢোঁকে সবটুকু পানীয় গলায় ঢেলে দিলেন !
আমি বললাম , ” খুব দামী ড্রিংক , না ?”
-“ব্যাপারটা যাচ্ছেতাই !এক পাউন্ড খরচ করে এমন জিনিস কিনল যেটা এক ঢোঁকে গলায় ঢুকে যায় ?
আমি বললাম, “কোথায় এক পাউন্ড, এটা কিনতে ওর খরচ হয়েছে একটা কুড়ি পাউন্ডের সিল্কের ছাতা !
মা বলল, : ঠিক তাই , লোকটা নিশ্চয়ই পাগল ।
ছোটখাট মানুষটি এখন খালি গ্লাসটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল , তার ফর্সা মুখটিতে এক গভীর প্রশান্তি খেলা করছে । দেখলাম, জিভ বের করে উনি গোঁফটা মুছে নিলেন, মহার্ঘ্য পানীয়ের শেষ বিন্দুটুকু যেন উপভোগ করছেন ।
বার কাউন্টার থেকে এবার উনি বেরিয়ে এলেন , ভিড় ঠেলে ওঁর হ্যাট আর কোট যেখানে রাখা আছে , সেদিকে গেলেন । মাথায় টুপি পরলেন , কোটটি গায়ে চড়ালেন । তারপর খুব আস্তে, মাখনের উপর ছুরি চালানোর মত করে কত স্ট্যান্ডে ঝুলে থাকা একটি ভেজা সিল্কের ছাতা নিয়ে কেটে পড়লেন সেখান থেকে ।
– “দেখলি দেখলি লোকটা কী করল ?”
– সসসস – আমি ফিসফিস করে বললাম, , ” উনি বেরিয়ে আসছেন !”
আমরা ছাতা দিয়ে নিজেদের মুখ আড়াল করলাম, আর তার নীচ দিয়ে ওকে লক্ষ্য করতে থাকলাম।
এবার উনি বেরিয়ে এলেন । আমাদের দিকে না তাকিয়েই নতুন ছাতাটা মাথায় দিয়ে ঠিক যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে হাটা লাগালেন ।
মা বলল , ” এটাই তাহলে ওর খেলা ?”
আমি বললাম, নীট !
আমরা ওর পিছু পিছু বড় রাস্তার ঠিক যে জায়গাটিতে আমাদের দেখা হয়েছিল, সেখানে গেলাম । কিছুক্ষন বাদেই দেখলাম, ওর নতুন ছাতাটিও হাতবদল হয়ে গেল, এক পাউন্ডের বিনিমযে । এবার অবশ্য ওর শিকার একজন রোগা লম্বা সাধারণ চেহারার লোক, যার পরনে কোটও ছিল না, মাথায় হ্যাট ও না । বিনিময় কার্য সমাপন হবার পরেই দেখলাম আমাদের ছোটখাট মানুষটি রাস্তা পার হলেন এবং জনসমুদ্রে মিশে গেলেন । কিন্তু এবার উনি রওয়ানা দিলেন উল্টো দিকে ।
মা বললো, ” কী চালাক লোকটা ! একটা পাবে দুবার যায় না !”
“আমি বললাম, ও তো রাত ভোর এই চালাতে পারবে !”মা বললো, ” হ্যাঁ , তবে দেখিস , ও নিশ্চয়ই যীশুর কাছে কেবল বৃষ্টির দিনের জন্য প্রার্থনা করে !
লেখাটি নেয়া হয়েছে দক্ষিণের জানালা পত্রিকা থেকে-