পুতুল-বিষাদ
পল গ্যালিকো
ভাষান্তর : অনিকেত সুর
আমার নাম স্টিফেন অ্যামোনি। পেশায় ডাক্তার। কর্মস্থল ও বসবাস লন্ডনে, টেমস নদীর ধারে। একটি পুতুলকে নিয়ে শুরু আমার এই গল্পের কাহিনি। গল্পটা অদ্ভুত হলেও সত্য।
বছর পাঁচেক আগের অক্টোবর মাসের একটি দিন। দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। প্রতিদিনের মতো আমি যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, তখন টেমস নদীর বুকে প্রভাত-সূর্যের আলো ঝিলমিল করছিল। যথারীতি দ্য টাইমস পত্রিকার একটি কপি কেনার জন্য আমি বেরিয়েছিলাম। যে-রাস্তায় আমার বাড়ি, তার মোড়ে একটি ফুলের দোকান ছিল।
মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছতেই দোকানের বিচিত্র উজ্জ্বল রঙের ফুলগুলি আমার নজরে এলো। আমি অ্যাবি লেনের দিকে ঘুরে হাঁটতে থাকলাম। অক্টোবর মাসের কোমল-উষ্ণ রোদটা বেশ লাগছিল।
কয়েক মিনিট পর আমি খবরের কাগজের দোকানে পৌঁছলাম। মনে পড়ল, আগামী সপ্তাহে আমার ভাগ্নির জন্মদিন। তাই দোকানের জানালায় চোখ বুলিয়ে ওর জন্য একটা জুতসই উপহার খুঁজতে লাগলাম। নানান খেলার সামগ্রী, কলম, কাগজ, বই, চকোলেট, মিষ্টি এসবের মধ্যে আমার দৃষ্টি ঘুরতে লাগল। ক-বছর ধরেই জিনিসগুলি আমি ওখানে দেখছি। যখন প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি যে ওসবের মধ্যে ভাগ্নিকে দেওয়ার মতো বিশেষ তেমন কিছু নেই, তখনই আমার নজর গেল একটি পুতুলের দিকে – পুতুলকন্যা। জানালার এককোণে আধ-ঢাকা ওর শরীর। পুতুলটি কাপড়ের তৈরি এবং ওর মুখটা তুলির আঁচড়ে আঁকা।
ওই মুখের একটা বিশেষত্ব ছিল – সুন্দর, কোমল আর আকর্ষণীয়; কিন্তু চোখ দুটি বিষাদে ভরা। একটি পুতুলের মুখ বরাবর অভিব্যক্তিহীন হয়। কিন্তু এ দেখছি একেবারেই আলাদা। হাবিজাবি নানা জিনিসের ভেতর ওর ওই বিষণ্ন
চোখ-মেলে-দাঁড়িয়ে-থাকা দেখে আমার মনটাও কেমন বিষাদে ছেয়ে গেল। জানি, একথা শুনতে অদ্ভুত শোনাবে। আমি দোকানের ভেতরে ঢুকে ওর মুখটা আরো কাছ থেকে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোকানটির মালিক ছিল জিম কার্টার নামে এক লোক।
‘সুপ্রভাত, ডা. অ্যামোনি’ – ভেতরে ঢুকতেই আমাকে উচ্ছল কণ্ঠে সম্ভাষণ জানালো জিম। ‘পত্রিকা নেবেন?’
‘হ্যাঁ, জিম। আর আমার ভাগ্নিকে একটা উপহার দেব ভাবছি। আগামী সপ্তাহে ওর জন্মদিন।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ! আমি ওই কাপড়ের পুতুলটা দেখছিলাম। ওই যে ওই কোনায়, অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে যে-পুতুলটির।’
জিম খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘পুতুলটা কিছুটা অস্বাভাবিক। অন্যসব পুতুলের মতো নয়।’
‘সেজন্যই তো দেখতে চেয়েছি ওটা’, আমি বললাম।
‘এবং ওর দামটাও খুব বেশি।’
জিম পুতুলটা নিয়ে আমার হাতে দিলো। বিস্মিত আমি পুতুলটা হাত থেকে প্রায় ফেলেই দিয়েছিলাম। এত সুন্দরভাবে ওটা বানানো যে, ওকে বেশ জীবন্ত মনে হচ্ছিল আমার। ওর পোশাকটা ছিল সম্পূর্ণ কাপড়ের তৈরি। হ্যাঁ, ওর মুখ রংতুলিতেই আঁকা। এবার আমি তা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মনোহর! এই শব্দটাই আমার মনে এলো। ওকে গড়া হয়েছে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা দিয়ে এবং এই ভালোবাসা আমি পুতুলটার মুখে আঁকা রয়েছে দেখতে পেলাম।
আলতো হাতে পুতুলটাকে নামিয়ে রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওর দাম?’
‘বারো পাউন্ড, ডা. অ্যামোনি’, জবাব দিলো জিম।
আমার মুখের বিস্মিত ভাবটা ওর নজর এড়াল না – ‘ওর দামটা বেশি। আমি তো বলেছি আপনাকে, বলিনি?’
‘হ্যাঁ, তা বলেছেন।’
‘লন্ডনের কেন্দ্রে এরকম পুতুলের দাম আছে কুড়ি পাউন্ড’, জিম বলল। ‘কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমি এগারো পাউন্ড নেব।’
‘কে বানায় এ-পুতুল?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘এত সুন্দর পুতুল যে বানাতে পারে, তার সম্পর্কে জানার কৌতূহল হচ্ছে আমার।’
‘ভদ্রমহিলা থাকেন হার্ডলি স্ট্রিটে। মাঝে-মধ্যে আমার দোকানে আসেন এই পুতুলগুলি নিয়ে।’
‘কী নাম তাঁর?’
‘নিশ্চিত বলতে পারছি না। ‘ক্যালামি’ বা এরকমেরই কিছু একটা হবে।’
‘দেখতে কেমন?’
‘লম্বা। মাথায় লাল চুল। খুব দামি কোট-হ্যাট পরেন। কিন্তু মুখটা থমথমে। কোনো কোমল অনুভূতি নেই ওই মুখে। দোকানে এলে কথা বলেন খুবই কম। সত্যি বলতে, তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল জিম, ‘আমি তাঁকে কখনো হাসতে দেখিনি। দুর্বোধ্য এক ব্যাপার। এরকম একজন মহিলা কিভাবে এত সুন্দর পুতুল বানায়।’
‘পুতুলটা নিচ্ছি’, আমি বললাম।
একটা পুতুলের দাম এগারো পাউন্ড হওয়াটা বাড়াবাড়ি। জিমের হাতে নোটগুলি গুনে দেওয়ার পর নিজেকে কিছুটা বোকা বোকা লাগল। ওটা একটা উপহার, তা ঠিক। তবে আমি জানি ওটা কেনার আসল কারণ কী। আমি চাইনি, ওটা দোকানের জানালায় পড়ে থাক। পুতুলটা বাড়িতে এনে আমার শোবার ঘরে রাখলাম। আমার ঘর ভরে উঠল ওর সৌন্দর্যে।
একটা বাক্সের ভেতর ওকে আলগোছে রাখলাম আমি। তারপর একটা বাদামি রঙ কাগজে বাক্সটা মুড়ে নিলাম। বিকালের দিকে কাছের ডাকঘরে গিয়ে পাঠিয়ে দিলাম ভাগ্নিকে।
পরবর্তী দিনগুলিতেও ওই পুতুলটি, কিংবা ওর কোমল সুন্দর মুখ আর বিষণ্ন চোখ দুটি নিয়ে আমার ভাবনা থামল না।
যে-নারীটি ওই পুতুল বানিয়েছেন, জিমের বর্ণনা অনুযায়ী তাঁর চেহারাটা আমি কল্পনা করলাম। এরকম একজন নারী কীভাবে এত সুন্দর পুতুল গড়তে পারে! বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন। সুতরাং, আদতে কে এই নারী? আমার জানার খুব আগ্রহ হলো।
কিন্তু এদিকে আবার ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। এলাকার শিশুরা অসুস্থ হতে লাগল। আমিও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। এবং শিগগিরই ওই নারী আর পুতুলের কথা ভুলে গেলাম।
কয়েক সপ্তাহ পর একদিন আমার ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল। ও-প্রান্তে এক নারীকণ্ঠ, ‘ডা. অ্যামোনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি বাড়িতে রোগী দেখতে যান?’
‘হ্যাঁ, কখনো কখনো।’
‘ফি কী রকম নেন?’ কণ্ঠটা বেশ কর্কশ। মহিলা যেন ভাবছে, অসুস্থ ব্যক্তির চাইতে আমার কাছে টাকাটাই বড়।
‘পাঁচ পাউন্ড’, আমি বললাম। ‘কিন্তু আপনি যদি দিতে অক্ষম হন, সেক্ষেত্রে আমি ফি দাবি করছি না।’
‘সমস্যা নেই। আমি পাঁচ পাউন্ড দিতে পারব।’
‘আপনার নাম?’
‘রোজ ক্যালামিট। হার্ডলি স্ট্রিটে যে কেকশপটি আছে, তার পাশের বাড়িতেই আমি থাকি। দোতলায় আমার ঘর।’
‘শিগগির আসছি’, বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
দশ মিনিটের ভেতর আমি পৌঁছে গেলাম সেই বাড়িতে। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা ছিল সংকীর্ণ, নোংরা ও প্রায় অন্ধকার। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছতেই একটা দরজা খুলে গেল। ‘ডা. অ্যামোনি?’ প্রশ্ন করল কর্কশ কণ্ঠ।
‘হ্যাঁ।’
‘প্লিজ ভেতরে আসুন। আমি রোজ ক্যালামিট।’
মহিলা লম্বা। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। লাল চুল। কালো চোখ। লালচে উজ্জ্বল মুখ। দুজনে সামনের কামরায় ঢুকলাম – ঠান্ডা, কুৎসিত একটা ঘর। আসবাবপত্র সস্তা আর দেখতেও বাজে। কোণের একটা আলমারির ওপর অনেকগুলি ছোট ছোট কাচের বোতল চোখে পড়ল। তারপর দেখলাম পুতুলগুলি। কিছু দেয়ালে ঝুলছে, বাকিগুলি বিছানা জুড়ে এলোমেলো ছড়ানো। প্রতিটি পুতুল আলাদা, কিন্তু প্রতিটিই আমার কেনা সেই পুতুলের মতো সুন্দর। এই রুক্ষ কর্কশ রসকষহীন মহিলাটি এগুলি বানাতে পারে, এটি আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হলো। রোজ ক্যালামিট আমার দিকে দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘একজন ডাক্তার হিসেবে আপনার বয়েসটা খুব কম।’
‘আমাকে দেখতে আমার বয়সের তুলনায় ছোট মনে হয়’, আমি ঠান্ডা গলায় বললাম। ‘আপনি ভাবছেন, আমার বয়স খুব কম। আমি কি চলে যাব তাহলে?’
মহিলা বেশ জোরে হেসে উঠলেন। ‘রাগ করার প্রয়োজন নেই, ডাক্তার। আপনি খুব সুদর্শন। সচরাচর একজন ডাক্তার এত সুদর্শন হয় না।’
‘এবং আমি একজন ব্যস্ত ডাক্তার’, আমি বললাম। ‘রোগী কে, আপনি?’
‘না। আমার ভাতিজি। ও পেছনের কামরায় আছে। চলুন, যাওয়া যাক।’
অন্য কামরায় প্রবেশের আগেই আমি জানতে চাইলাম, ‘পুতুলগুলি বানায় কে, আপনি?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
এই জবাব শুনে আমি মর্মাহত হলাম। আমি এটা আশা করিনি। ‘এরকম একটা পুতুল আমি কিনেছিলাম। জন্মদিনে একজনকে উপহার দেব বলে’, শান্ত গলায় বললাম আমি।
মহিলা আবার অদ্ভুত হাসি হাসলেন – ‘এবং নিশ্চয়ই বেশ চড়া দামে কিনেছেন?’
পেছনের কামরার দরজাটি খুলতে খুলতে তিনি বললেন, ‘মেরি, ডাক্তার এসেছে। আর হ্যাঁ, ডাক্তার, আপনি ওকে দেখে অবাক হবেন না। ওর বাম পা’টি কিন্তু বাঁকা।’
মেরি নামের মেয়েটি বসে আছে চেয়ারে। জানালার পাশে। শেষ দুটি বাক্য যদিও আমার উদ্দেশে বলা, তবু তা ওই মেয়েটিও শুনতে পেয়েছে, সন্দেহ নেই। দেখলাম ওর পাণ্ডুর মুখটায় একটা বেদনার ছায়া ফুটে উঠল; গাঢ় ডাগর চোখ দুটিতে বিষাদ ঘনতর।
কথাগুলি বলার কোনো দরকার ছিল না। খুব রাগ হলো আমার। সন্দেহ হলো, ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই মহিলাটি ওসব বলেছেন।
মেরির বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। কিন্তু ওকে দেখেই আমি বুঝলাম, ও অসুস্থ। ওর চোখ দুটির দিকে নজর ফেরালাম আমি। ‘কিছু একটা মরে যাচ্ছে ওর ভেতরে’, আমি ভাবলাম।
মেরিকে প্রথম দেখার পর থেকেই ওর সেই মিষ্টি কোমল বিষণ্ন মুখ, ওর ক্ষীণ পলকা শরীর আর রোগাটে শুষ্ক চুলের কথা আমার সবসময় মনে পড়ত। আবার একটা কিছু আমাকে আনন্দও দিত। ওর তিন দিকে তিনটি টেবিল এবং সেগুলির ওপর পুতুল বানানোর সব দরকারি জিনিস : উজ্জ্বলবর্ণ সব রং, নানা বর্ণ ও আকারের কাপড়ের টুকরা; আমি দ্রুত বুঝে নিলাম, ওর বাঁকা পা ওর অসুস্থতার কারণ নয়।
আমি ওর বসার ভঙ্গি লক্ষ করলাম। ভাবলাম, আমি তো ওর পা’টাকে সোজা করে দিতে পারি; আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে আমি সেটি পারব।
কিছুক্ষণ পর আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেরি, তুমি কি হাঁটতে পার?’
প্রশ্ন শুনে ও আমার দিকে একপলক তাকাল। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল – ‘হ্যাঁ’, জবাব দিলো মৃদু গলায়।
‘প্লিজ, একটু হেঁটে আসো তো আমার দিকে’, নিচুস্বরে আমি বললাম।
‘ওহ্! নাহ্, আমাকে এটা করতে বলবেন না’, ওর কণ্ঠে দ্বিধা। ‘আমি চাই না আন্টি কষ্ট পাক।’
কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে আমার ভাবনা ঠিক। তাই বললাম, ‘প্লিজ, একটু চেষ্টা করো হাঁটতে।’
খুব সাবধানে ও চেয়ার ছেড়ে উঠল। ধীরপায়ে একটু একটু করে এগোতে লাগল। ওর বাম পায়ের দিকে মনোযোগ দিলাম আমি। – হ্যাঁ, আমার ভাবনাই ঠিক! ‘বেশ’, – মৃদু হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে; ওকে বোঝাতে চাইলাম যে, এই পরীক্ষায় আমি সন্তুষ্ট। এবং হাত বাড়ালাম ওকে সাহায্য করার জন্য। ও আমার দিকে তাকাল। ফের ওর মুখটায় আমি সেই হতাশা ও বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখলাম।
মনে হলো, আমার সাহায্যের জন্য ও নীরবে চিৎকার করছে। একবার দু-হাত ওঠাল আমার হাত ধরার জন্য, পরক্ষণেই আবার সেগুলি ওর দেহের দুপাশে স্থির হলো।
‘কতদিন ধরে এরকম অবস্থা তোমার?’ আমি জানতে চাইলাম।
রোজ ক্যালামিট ওর হয়ে জবাব দিলেন, ‘ওর পা বাঁকা তো আজ দশ বছর ধরে। কিন্তু আমি আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে। ও অসুস্থ। আমি জানতে চাই, কী ওর অসুখ।’
মনে মনে বললাম, ‘হ্যাঁ, ও অসুস্থ। সম্ভবত মারা যাচ্ছে। ওকে দেখেই তো একথা মনে হয়েছে আমার।’
চাইছিলাম, রোজ ক্যালামিট কক্ষ ছেড়ে যাক। একা শুধু মেরির সঙ্গেই কথা বলব আমি। কিন্তু মহিলা দাঁড়িয়ে রইলেন। উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, ‘আমি এখানেই থাকছি, ডা. অ্যামোনি। আপনি মেরিকে দেখুন। তারপর আমাকে বলুন, কী ওর সমস্যা।’
মেরির শরীর পরীক্ষা করে আমি রোজের সঙ্গে সামনের কক্ষে চলে এলাম – ‘ওর পা আমি সোজা করে দিতে পারি। এবং ও স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতোই হাঁটতে পারবে,’ আমি বললাম।
‘থামুন’, চিৎকার করে উঠল মহিলা। ‘যথেষ্ট হয়েছে। এ-বিষয়ে আপনি ওকে আর কিছুই বলবেন না। সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞ ডাক্তাররাও কিছু করতে পারেনি। কোনো তরুণ অর্বাচীন যেন ওকে আশার বাণী না শোনায়। যদি আপনি আবার একথা বলেন তো এখানে আপনাকে আর আসতে দেব না। আমি জানতে চেয়েছি, ওর সমস্যাটা কী। ও কিছু খাচ্ছে না। ঘুমাতে পারছে না। কোনো কাজও করছে না। এখন বলুন, ওকে পরীক্ষা করে কী পেলেন?’
‘দৈহিক কোনো সমস্যা ওর নেই মনে হচ্ছে। কিন্তু জানি, কিছু একটা ওকে ক্ষয় করে দিচ্ছে নীরবে। কিছু ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি আপাতত। ওর শরীরে বল ফিরে আসবে। কিছুদিনের মধ্যে আমি আবার আসব ওকে দেখতে।’
‘ওর পা সোজা করার বিষয়ে কিছু বলবেন না কিন্তু। বুঝেছেন? যদি তা করেন, আমি অন্য ডাক্তার ডাকব।’
‘বেশ’, আমি বললাম।
মেরিকে আবার দেখতে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। ভাবলাম, ওর শরীরে শক্তি ফিরে আসার পর ওর পায়ের ব্যাপারে কথা বলব।
ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় নেওয়ার জন্য তৈরি হলাম – ‘মনে করেছিলাম, পুতুলগুলি বুঝি আপনি তৈরি করেন’, এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রোজ তাঁর স্বভাবসুলভ রুক্ষ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘আমিই তৈরি করি। আমি ছবিগুলি এঁকে দিই। মেরি কাপড় দিয়ে বানায়। আর এই কাজ ওর পায়ের ব্যাপারে বেশি চিন্তা করা থেকে ওকে বিরত রাখে। ওর যে বিয়ে হবে না, বাচ্চাকাচ্চা হবে না, এই কঠিন সত্যটা ও যেন ভুলে থাকে, সেটাই আমি চাই।’
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। অক্টোবর মাসের ঝলমলে সূর্যালোকের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হলো, রোজ মিথ্যা বলছেন। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলো না যে, বিশেষ ধরনের ওইসব পুতুল তৈরির সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে সুন্দর মনের একজন মানুষই কেবল জড়িত। রোজ ক্যালামিট মেরিকে ব্যবহার করছেন টাকা কামানোর কলের মতো।
এই আবিষ্কারে আমি যেমন আনন্দ পেলাম, তেমনই মেরির জন্য সমান দুশ্চিন্তাবোধও হলো। আমাকে জানতে হবে ওর সমস্যা কী। এবং জানতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। ওর মৃত্যু হওয়ার আগেভাগেই।
পরবর্তী কয়েকটি ভিজিটে আমি মেরি সম্পর্কে আরো কিছু জানলাম। পুরো নাম মেরি নোলান। ওর বয়েস যখন পনেরো বছর, এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ওর বাবা-মা দুজনেই মারা যায়; মেরি মারাত্মক আহত হয়।
রোজ ক্যালামিট মেরিকে দেখাশোনা করবেন বলে প্রস্তাব দিলে আইন রায় দেয় তাঁর পক্ষে, কারণ অল্পবয়েসি অনাথ মেয়েটির ভার নেওয়ার জন্য অধিক গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি তখন আর পাওয়া যায়নি।
রোজ ভেবেছিলেন, মেরির বাবা ধনী। তারপর যখন তিনি জানতে পারলেন, সামান্য কিছু অর্থ ছাড়া আর কোনো
সম্পদ-সম্পত্তি তাঁর নেই, তখন থেকে মেরির সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে শুরু করলেন। পীড়ন চালাতে লাগলেন ওর মনের ওপর। এবং মেরি ওর পায়ের কথা কখনো ভুলতে পারল না। ওর আন্টি তাঁর আচরণে মেরিকে যেন সারাক্ষণ একথা মনে করিয়ে দিতে লাগলেন – ‘কোনো পুরুষ তোমাকে ভালোবাসবে না। তোমার কখনো বিয়ে হবে না, বাচ্চা-কাচ্চা হবে না। কোনো পুরুষ বাঁকা পায়ের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে না।’
বছরগুলি গড়াতে লাগল আর মেরিও ওর আন্টির কথা বিশ্বাস করতে শুরু করল। থেকে গেল তার সঙ্গে। আন্টি যা বলত, মেরি তাই করত। আন্টিকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ সে খুঁজে পেল না। এভাবেই আশাহীন অসুখী এক জীবনে বন্দি হয়ে গেল ও। তারপর পুতুল বানাতে শুরু করল একদিন।
রোজ ক্যালামিট দেখলেন পুতুলগুলি কী অদ্ভুত সুন্দর। শিগগিরই বুঝে নিলেন, পুতুলগুলি অনেক টাকায় বিক্রি হবে এবং তাঁর ধারণা সঠিক প্রমাণিতও হলো। কিছু পুতুল বিক্রি হওয়ার পরে রোজ সিদ্ধান্ত নিলেন, মেরিকে সপ্তাহের প্রতিটি দিনই পুতুল বানাতে হবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। রোজের মনে মেরির প্রতি কোনো ভালোবাসা ছিল না।
কয়েক বছরে মেরি শত শত পুতুল বানিয়েছে। রোজ সেই পুতুল বিক্রির টাকা পেয়ে খুশি। এখন মেরি অসুস্থ। রোজ দেখলেন, মেরি মরে গেলে পুতুল বিক্রির ব্যবসাটা তার থেমে যাবে। টাকাও আসবে না।
কিন্তু মেরি কেন ক্রমশ মরে যাচ্ছে? আমি এখনো জানি না। ওর আন্টিকে ও ভয় পায়, আমি দেখেছি। কিন্তু সেটাই কি কারণ হতে পারে? একটা সুস্পষ্ট জবাব আমার চাই।
মেরিকে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি আমার। কারণ আমি যতক্ষণ ওর সঙ্গে থাকতাম, ওর আন্টিও থাকত আমাদের সঙ্গে। রোজ ক্যালামিট ওই ঘরে থাকলে মেরি কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করত।
মেরিকে এখনো বলা হয়নি যে, খুব সম্ভবত আমি ওর পায়ের সমস্যাটির সমাধান করে দিতে পারি। কেন ও জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তা জানাই আমার জন্য এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেরিকে পুতুল বানাতে নিষেধ করলাম। ওর জন্য কিছু বই আর চকোলেট কিনে আনলাম।
পরবর্তী দশ দিনে ওর অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে বলে মনে হলো। এরপর যখন আবার ওকে দেখতে এলাম, এই প্রথম মৃদু হাসল ও আমাকে দেখে।
‘হ্যাঁ, আগের চেয়ে একটু ভালো দেখাচ্ছে তোমাকে’, আমি বললাম। ওর খুশিভরা মুখটা দেখে আমার ভালো লাগল – ‘আরো দশ দিন পুতুল নিয়ে কোনো কাজ নয়, ঠিক আছে? আমি চাই না, তুমি কাজ করো। এই কয়দিন শুধু বিশ্রাম নাও, ঘুমাও আর বই পড়ো। তারপর দেখব কী করা যায়।’
আমি লক্ষ করলাম, রোজ ক্যালামিট আমার কথায় নাখোশ।
কিছুদিন পর যখন আমি আবার মেরিকে দেখতে গেলাম, রোজ আমার জন্য সামনের ঘরটায় অপেক্ষা করছিল। ‘আপনাকে আর আসতে হবে না, ডা. অ্যামোনি’, ঠান্ডা গলায় আমার উদ্দেশে বলল।
‘কিন্তু মেরিকে অবশ্যই …’ কথাটা শেষ করা গেল না। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে ত্বরিত বলে উঠল রোজ, ‘মেরি এখন যথেষ্ট ভালো। বিদায়, ডক্টর।’
ঘরের কোণে বাক্সটার দিকে চোখ ঘুরে গেল আমার। দেখলাম ওটার ওপর সদ্য-বানানো তিনটি আনকোরা পুতুল। দেখতে সেগুলি বরাবরের মতোই সুন্দর। কিন্তু এবার ওদের চোখে ফুটে উঠেছে মৃত্যুভয়। হঠাৎ মেরিকে ঘিরে একটা শঙ্কা জেগে উঠল আমার মনে। রোজ ক্যালামিট মিথ্যা বলছেন, আমি বুঝলাম। মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা ঠেলে আমি মেরির ঘরে ঢুকতে চাইলাম।
কিন্তু আমি একজন ডাক্তার এবং ডাক্তারকে যখন ঘর ছেড়ে যেতে বলা হয়, তখন তাই করতে হয় তাঁকে। আমি তখনো জানি না, মেরির সমস্যা কী, কিন্তু আন্দাজ করলাম, রোজ আরেকজন ডাক্তার ডেকেছে। তাই বিষণ্ন মনে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। কেবল ভুলতে পারলাম না মেরির কথা।
কয়েকটি দিন মেরির জন্য উদ্বেগে কাটল। কিছুদিন বাদে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রথমদিকে সামান্য মাত্রায়, কিন্তু দিন যতই গড়াতে লাগল, আমার অবস্থা ক্রমশ আরো খারাপ হচ্ছিল। এক বন্ধু ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার জন্য গেলাম। সে বলল, ‘কোনো সমস্যাই নেই তোমার শরীরে। হয়তো ইদানীং বেশি পরিশ্রম করছ।’
কিন্তু আমি জানতাম, এটা কোনো কারণ নয়। ক্রমে আরো খারাপ হলো আমার অবস্থা। খাবারে অরুচি এলো। ওজন কমে যেতে লাগল। শরীর শুকিয়ে যেতে শুরু করল। ক্লান্তিবোধ আর অনিদ্রা চেপে বসল আমাকে।
মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, সাহায্যের জন্য মেরি আমার কাছে আসতে চাইছে আর রোজ ক্যালামিট তাঁর নোংরা দুটি শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছেন। মেরির কথা সারাক্ষণ ভাবতাম। আমি ওকে সাহায্য করতে পারিনি। অথচ আমার সাহায্য ওর দরকার ছিল।
এক রাতে আমার ঘুম আসছিল না। নিজের অসুস্থতার কথা ভাবতে ভাবতে শোবার ঘরে এদিক-ওদিক পায়চারি করছিলাম। মনে হলো, মেরির মতো একই অসুখে ভুগছি আমি। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমার অসুখটা কী – আমি মেরি নোলানকে ভালোবাসি। এবং যেহেতু ওর দেখাশোনা করতে পারছি না, তাই আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
সঙ্গে সঙ্গে আমি এও বুঝলাম, কেন মেরি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ কেউ ওকে ভালোবাসে না। পৃথিবীতে ওর এমন কেউ নেই যে ওর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওকে আশাবাদী করে তুলবে। ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। ওর আন্টি ওকে নিজের কাছে রেখেছে ওর পুতুল বেচে টাকা কামাবে বলে। মেরির কোনো বন্ধু নেই। আর নিজেকে ও কুৎসিত ভাবছে ওর পায়ের কারণে। ওই পুতুলগুলি ছাড়া ওর জীবন অর্থহীন।
নাহ্! মেরির সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ আমার কথা বলতে হবে, একা। নয়তো ও আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। সারারাত নিজের মনে কথাগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম আমি। রাতভর ভাবলাম ওকে নিয়ে এবং পরদিন দোকানে জিম কার্টারকে ফোন দিলাম।
‘ডা. অ্যামোনি বলছি। জিম, আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’
‘যথাসাধ্য করব’, জিম বলল। ‘গত বছর আপনি আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। আমি তা কখনো ভুলব না। বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?’
‘ধন্যবাদ, জিম’, আমি বললাম। ‘রোজ ক্যালামিটের কথা মনে আছে আপনার? সেই পুতুল-বেচা মহিলা?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই!’ জবাব দিলো জিম।
‘সে যখন আপনার দোকানে আসবে, আমাকে ফোনে জানিয়ে দেবেন। তারপর তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলবেন। আমি কুড়ি মিনিট সময় চাই। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ, জিম। আপনার এই সাহায্যের কথা আমি মনে রাখব।’
এরপর থেকে যখনই ঘরের বাইরে যেতাম, মনে হতো, জিমের কল এই এলো বুঝি! এবং প্রতি বিকেলে ঘরে ফেরার সময় ওর দোকানের দরজায় নজর বুলিয়ে আসতাম। জিম মাথা নাড়ত। মানে, কোনো খবর নেই।
একদিন বিকেল পাঁচটায় টেলিফোন বাজল। ‘সে এসেছে!’ জিম বলল অনুচ্চকণ্ঠে। আর দ্রুত আমি দৌড়ে গেলাম সেই বাড়িটিতে, যেখানে মেরি থাকত। আবার এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম দোতলায়। সৌভাগ্যক্রমে দরজা খোলাই ছিল। ব্যস্ত পায়ে মেরির কক্ষটিতে ঢুকে দেখলাম, শরীর আরো শুকিয়ে গেছে ওর। আরো বেশি রুগ্ণ দেখাচ্ছে ওকে। ওর চারপাশে তখনো সেই রঙের কৌটাগুলি আর বেশকিছু টুকরা কাপড়। – ভাবলাম, ‘মৃত্যুর আগে ও অন্তত আরো একটি পুতুল বানাতে চায়!’
মুখ তুলে চাইল মেরি। হয়তো ভেবেছিল রোজ এসেছে। কিন্তু আমাকে দেখে বিস্ময়ে ওর চোখ ছানাবড়া।
আমার নাম ধরে ডাকল ও। ‘ডা. অ্যামোনি’ নয়। বলল ‘স্টিফেন।’
‘মেরি!’ আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। আমি জানি, তোমার অসুখটা কী।’
‘এখন কিছু আর কী হবে!’ মেরির কণ্ঠ শান্ত নৈরাশ্যে ভরা।
‘এখনো সময় আছে, মেরি। আমি বুঝেছি সব। আমি জানি কীভাবে তোমাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আমার কথা শোনো মনোযোগ দিয়ে …’
‘না’, চোখ বন্ধ করে শান্ত গলায় ও বলল। ‘কিছু বলো না, স্টিফেন, প্লিজ। আমি শুনতে চাই না। আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।’
আমি বসে পড়লাম এবং ওর হাত দুটি ধরলাম। ‘মেরি, প্লিজ শোন। বেড়ে ওঠার সময় শিশুরা পরিবার থেকে ভালোবাসা পায়। যখন ওরা বড় হয়, তখন নিজেরাও অন্যদের সেই ভালোবাসা দিতে পারে। একই সঙ্গে অন্যদের কাছ থেকেও ওরা ভালোবাসা, সহানুভূতি, সুখ ও ভরসা পায়। তুমি শুধু একতরফা ভালোবাসা দিয়েই গেছো, মেরি, কিন্তু কিছুই পাওনি। এখন তোমার ভেতরে ভালোবাসার উৎসমুখ শুকিয়ে গেছে। দেওয়ার শক্তি আর তোমার নেই।’
আমি বুঝতে পারছিলাম না, ও আমার সব কথা শুনতে পাচ্ছে কি না। কিন্তু আমি প্রাণপণ চাইছিলাম ও বাঁচুক। আমাকে আমার কথা শেষ করতেই হবে। –
‘তোমার আন্টি তোমার কাছ থেকে সমস্ত সুখ ও ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। এরপর আরো খারাপ কিছু করেছে সে। তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তোমার সন্তানদের …’
কথা থামিয়ে আমি মেরির মুখের দিকে তাকালাম। – ওর চোখ দুটি বন্ধ। দেহে কোনো নড়াচড়া নেই। – ‘আমি কি ওকে মেরে ফেলেছি? এই আমি যে ওকে ভালোবাসি?’ পরক্ষণেই টের পেলাম আমার হাতে ওর হাতের আঙুলের নড়াচড়া। ধীরে ও চোখ মেলে তাকাল। মনে হলো, আমার কথায় ও আনন্দ পেয়েছে। আমি আশান্বিত হলাম। আরো নিচুতে নামিয়ে আনলাম আমার কণ্ঠস্বর – ‘ওই পুতুলগুলি ছিল তোমার সন্তান, মেরি। ভেবেছিলে তুমি মা হতে পারবে না। তাই ওইসব পুতুল বানিয়েছ। আর প্রতিটি পুতুলের ভেতর একটু একটু করে ঢেলে দিয়েছ তোমার হৃদয়ের ভালোবাসা। খুব যত্ন দিয়ে, মমতা দিয়ে, নম্র কোমল হাতে গড়েছো ওদের আর ভালোবেসেছ নিজের সন্তানের মতো। তারপর তোমার আন্টি ওদের কেড়ে নিল তোমার কাছ থেকে। তোমাকে দেয়নি সে কিছুই। তুমি তোমার ভালোবাসার সবটুকু দিতে লাগলে, উজাড় করে, তিলে তিলে তোমার সবটুকু সঞ্চয় নিঃশেষ করে। – মানুষ কখন মারা যায়? যখন তার ভেতরে আর কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে না। মেরি!’
আমি আমার কথা শেষ করলাম। মেরির শরীরে মৃদু কম্পন দেখা দিলো। মনে হলো, ও আমার প্রতিটি কথাই শুনেছে, বুঝতে পেরেছে। – ‘কিন্তু তুমি মরবে না, মেরি। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি শুনতে পাচ্ছ? আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।’
শান্ত গলায় এবার কথা বলল মেরি, ‘আমাকে ভালোবাসো? কিন্তু আমার পা যে বাঁকা। কী করে ভালোবাসবে আমাকে?’
‘কোনো ব্যাপার নয়, মেরি। তবু আমি তোমাকে ভালোবাসি’, ধীর শান্ত কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম। ‘তোমার আন্টি মিথ্যা বলেছে তোমাকে। আমি তোমার পা সোজা করে দিতে পারব। এক বছরের মধ্যেই অন্য মেয়েদের মতো একদম স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারবে তুমি।’
মেরির চোখে টলমল ক’রে উঠল আনন্দাশ্রু। হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিলো আমার উদ্দেশে। আমি ওকে আমার দু-বাহুতে জড়িয়ে নিলাম। ও আমাকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল।
ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে এবার আমার কোটটা ওর দেহের চারপাশে জড়ালাম। ওকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ঘরের দরজার দিকে। হঠাৎ জোরে সামনের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। কেউ একজন দৌড়ে এদিকেই আসছে।
মেরির ঘরের দরজা সশব্দে খুলে গেল আর ভেতরে ঢুকল ক্রুদ্ধ রোজ ক্যালামিট। ভয়ে কাঁপতে শুরু করল মেরি। আমার কাঁধে মুখ লুকাল। কিন্তু রোজ ততক্ষণে দেরি করে ফেলেছে। এখন কিছুই করার নেই তার। সে জানে, এখন আমার বাহুবন্ধন থেকে কেউই আর মেরিকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
যখন মেরিকে নিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, একটি শব্দও তার মুখ দিয়ে বেরোল না। মেরি আমার বাহুর মজবুত বন্ধনে বাঁধা। সামনের দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম রাস্তায়। বাইরে ঝকমক করছে সূর্যের আলো। মাথার ওপরে প্রশস্ত আকাশটা নীল। মেরিকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, রাস্তায় তখন শিশুদের কলকণ্ঠ, ওরা খেলছে আনন্দে।
সেদিনের পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এই কাহিনি আমি যখন লিখতে বসেছি, আমার স্ত্রী মেরি বাগানে খেলছে আমাদের তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে। জানালা দিয়ে আমি মা ও ছেলের খুনসুটি দেখছি। ঝোপের আড়ালে হঠাৎ লুকিয়ে গিয়ে ছেলে মাকে বোকা বানাতে চাইছে। বিকেলের সূর্যের আলো এসে পড়েছে মেরির রাঙা হাস্যোজ্জ্বল গালে। ওর ইচ্ছেতেই আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ঘরে আসছে আর তিন মাস পর।
মেরি এখন আর পুতুল বানায় না। ওর দরকার হয় না। কিন্তু আমি নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানাই সেই দিনটিকে যখন আমি জিম কার্টারের দোকানের জানালায় সেই অদ্ভুত সুন্দর পুতুলটির প্রেমে পড়েছিলাম।
লেখক-পরিচিতি
আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প রচয়িতা পল উইলিয়াম গ্যালিকোর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৬শে জুলাই, নিউইয়র্ক শহরে। বাবা ইতালিয়ান আর মা ছিলেন অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত। তাঁরা দুজন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন ১৮৯৫ সালে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ পত্রিকায় গ্যালিকো কিছুদিন
চলচ্চিত্র-সমালোচক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২৩ সালে তিনি ওই পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ক্রীড়া বিষয়ে নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি তিনি ছোটগল্পও লিখতে থাকেন। ১৯৪১ সালে তাঁর লেখা উপন্যাসিকা দ্য স্নো গুজ প্রকাশিত হলে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বহুপ্রজ লেখক গ্যালিকো ৪১টি উপন্যাস এবং বহু ছোটগল্পের রচয়িতা। তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসের কাহিনি ভিত্তি করে অনেক মঞ্চনাটক, মুভি ও টিভি সিরিজ নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৫ই জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। আজকের লেখাটি তাঁর ‘দ্য ডল’ নামক ছোটগল্পের ভাষান্তর।