Homeঅনুবাদক্রিম - হারুকি মুরাকামি

ক্রিম – হারুকি মুরাকামি

ক্রিম

আমার এক তরুণ বন্ধুকে অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে বলছিলাম। তখন আমার বয়েস ছিল আঠারো। ঠিক মনে করতে পারছি না কেন তাকে সে-ঘটনা বলতে শুরু করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গেই ঘটনাটি উঠে এসেছিল। অনেক আগের সেই ঘটনা। বলা চলে প্রাচীন। যদিও ওই ঘটনার কোনো উপসংহারে আমি পৌঁছুতে পারিনি।

‘সবে মাত্র হাই স্কুল পাশ করেছি, তখনো কলেজে ভর্তি হই নি।’

বন্ধুকে বললাম, আমি ছিলাম যাকে বলে অ্যাকাডেমিক নিধিরাম সর্দার। যার কোনো শিক্ষক কিংবা গুরু নেই। যে ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় বিফল হয়ে অপেক্ষা করছে আরেকটি পরীক্ষার জন্য। এসব ভর্তির বিষয় আমার কাছে অনেকটা বায়বীয় মনে হয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আমি তেমন কোনো দ্বিধা অনুভব করিনি। আমি জানি চাইলেই মোটামুটি ভালো একটি প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হতে পারি। কিন্তু বাবা-মা চান, আমি যেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করি। সুতরাং আমি পরীক্ষা দিয়েছি এই জেনে যে, এবারের পরীক্ষায়ও বাতিলের খাতায় আমার নাম যাবে। অকার্যকর যে হবো সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় এলো। সেখানে আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে আছে অংক। উচ্চতর গণিতশাস্ত্রে আমার আগ্রহ একেবারে শূন্যের কোটায়। পরের বছর আমি কেবল সময় অপচয় করে কাটিয়েছি, তৈরি করেছি বেঁচে যাওয়ার নানান অজুহাত। পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পরিবর্তে আমি যাওয়া- আসা শুরু করেছিলাম স্থানীয় লাইব্রেরিতে। মোটা উপন্যাসের পাতায় নিজেকে ঠেসে ধরলাম। আমার বাবা-মা মনে করতেন, আমি লাইব্রেরিতে পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছি। আরে একটাই তো জীবন। দেখলাম ক্যালকুলাসের সূত্র সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেয়ে বালজাকের উপন্যাস পড়া আমি অনেক বেশি উপভোগ করছি।

সে-বছর অক্টোবরের শুরুর দিকে, আমি একটি মেয়ের কাছ থেকে আমন্ত্রণপত্র পেলাম তার ‘পিয়ানো কনসার্ট‘ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। সেই মেয়েটি স্কুলে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। তবে আমরা দুজনেই একই শিক্ষকের কাছে পিয়ানো বাজানো শিখতাম। একবার আমরা দুজনে একসঙ্গে মোজার্টের শর্ট ফোর-হ্যান্ডস পিয়ানোর নোট বাজিয়েছিলাম। ষোলো বছর বয়সে আমি পিয়ানোর তালিম নেওয়া বাদ দিই। এরপর মেয়েটির সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। অতএব আমি বুঝতে পারছি না কেন সে আমাকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র পাঠালো। আমাকে কি সে পছন্দ করতো? সেটা কীভাবে সম্ভব! মেয়েটি ছিল দেখতে অত্যন্ত রূপবতী, তার যে জীবনযাপন তা আমার মতো ছিল না। পোশাকে-আশাকে সে ছিল অত্যন্ত ফ্যাশনসচেতন। পড়তো একটি নামিদামি প্রাইভেট গার্লস স্কুলে। আমার মতো দেখতে একটি কারখানা শ্রমিকের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সে ছিল না।

আমরা একসঙ্গে পিয়ানো বাজানোর সময়, মেয়েটি সব সময় তীর্যক এক দৃষ্টিবাণে আমাকে আঘাত করতো, আর আমি ভুল নোট বাজাতাম। আমার তুলনায় সে অনেক ভালো পিয়ানো বাজাতো। আমি কিছুটা অস্থিরমতি ছিলাম। সুতরাং আমরা পাশাপাশি বসে যখন পিয়ানো বাজাতাম, তখন আমি অনেকগুলো নোট এলোমেলোভাবে বাজাতাম। সে-সময় আমার কুনুইও তাকে বারকয়েক খোঁচা দিতো। আমার স্বরলিপি তেমন কঠিন ছিল না। প্রতিবার আমার অংশ যখন বাজাই, তখন সে যেন ‘আমাকে একটু রেহাই দাও’ ধরনের বিরক্তি প্রকাশ করতো চোখে-মুখে। সে তার জিহ্বায় আঙুল ঠেকিয়ে বলতো – এতো উঁচুস্বরে নয়, সেটুকু উঁচুস্বরে বাজাও যাতে আমি বুঝতে পারি। আমি এখনো সেই শব্দ শুনতে পাই, এমনকি এখনো শুনছি। আমার পিয়ানো বাজানো ছেড়ে দেওয়ার পেছনে সম্ভবত সে-শব্দের একটি ভূমিকা ছিল।

একই পিয়ানো স্কুলে আমরা পড়তাম, এই ছিল আমাদের মধ্যে সম্পর্ক। দেখা হলে একে অপরকে ‘কেমন আছো’ এটুকুই, জিজ্ঞেস করতাম। মনে পড়ে না আমরা কখনো নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলেছি। হঠাৎ করে তার পিয়ানো অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ (তার একার নয়, আরো তিনজনের সঙ্গে বাজাবে) পেয়ে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম – যা আমাকে রীতিমতো হতবাক করেছিল। তখন আমার হাতে অনেক সময় ছিল, তাই আমন্ত্রপত্রের উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো। এর একটা কারণ ছিল, আমার খুব জানতে ইচ্ছে হলো, এই আমন্ত্রণ পাঠানোর পেছনে কী কারণ আছে – যদি সত্যিই কোনো উদ্দেশ্য থাকে! এতোদিন পরে কেন আমাকে এমন একটি অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হলো? সম্ভবত সে এখন অনেক ভালো পিয়ানো বাজায়, তা আমাকে দেখাতে চায়। অথবা সম্ভবত ব্যক্তিগত কোনো কথা ছিল যা সে আমাকে জানাতে চায়। আমি তখনো চেষ্টা করেছিলাম কীভাবে আমার কৌতূহল সংবরণ করা যায় এবং অবনতচিত্তে সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারি।

অনুষ্ঠানের হলটি ছিল কুবে পাহাড়ের একেবারে উঁচুতে। আমি হেনকো ট্রেনে চড়ে বসলাম যাতে করে যতটুকু সম্ভব পাহাড়টির কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে বাসে উঠলাম। আঁকাবাঁকা ঘোরানো একটি পথ বেয়ে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছালো বাস। আমি প্রায় পাহাড়চূড়ার কাছাকাছি নেমে পড়লাম। সেখান থেকে অল্প হেঁটেই পৌঁছুলাম আধুনিক একটি কনসার্ট ভেন্যুর সম্মুখে। ভেন্যুটির মালিক এবং পরিচালনা করে একটি বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। আমি জানতাম না যে, সেখানে একটি কনসার্ট হল ছিল – পাহাড়শীর্ষে এমন দুর্গম এবং শান্ত আবাসিক প্রতিবেশে! এ হিসেবে তুমি মনে করতে পারো, পৃথিবীতে অনেক বিষয় রয়েছে যার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।

আমার এমন কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত যাতে করে বোঝা যায় যে, আমন্ত্রণ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ। ট্রেনস্টেশনের কাছে একটি ফুলের দোকান থেকে একগুচ্ছ ফুল নিলাম, যা অনুষ্ঠানের সঙ্গে মানানসইও বটে। সে-ফুলগুলোকে একটি ঝুড়িতে র‌্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়ে নিলাম। এরপর বাস দেখামাত্রই উঠে পড়লাম। সময় ছিল রোববারের ঠান্ডা বিকেল। পুরো আকাশ ধূসর মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছিল যে-কোনো সময় ঠান্ডা বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। যদিও কোনো বাতাস ছিল না। আমি পরে ছিলাম নীল রঙের হ্যারিংবোন জ্যাকেটের নিচে পাতলা একটা সোয়েটার এবং আমার কাঁধে ঝোলানো ছিল একটি ক্যানভাস ব্যাগ। আমার জ্যাকেট ছিল একেবার নতুন। ব্যাগটি ছিল পুরনো এবং জীর্ণ। আমার হাতে ছিল সেলোফেন-মোড়ানো দৃষ্টিনন্দন লাল ফুলের তোড়া। আমি যখন বাসে উঠলাম, লক্ষ করলাম, অন্য যাত্রীরা আমার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। অথবা তাকিয়ে-থাকা যাত্রীরা মনে করছিল যে, তারা যদি এমন করতে পারতো – তাদের দৃষ্টি ছিল তেমনই। সে-পরিবেশে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। লাল হয়ে উঠেছিল দুই চোয়াল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, আমি মানুষের সামান্য দৃষ্টিবাণেই লজ্জিত – এ-কথা ভাবতেই আমার মুখ থেকে লালাভ ভাব চলে গেল।

নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখানে কেন? বাসের সিটে বসে ঘাড়ে হাতের তালু  বুলিয়ে কিছুটা স্থির হওয়ার চেষ্টা করি। আমি কেবল ওই মেয়েটিকে দেখতে চাইনি, শুনতে চাইনি তার পিয়ানো বাজানো। তাহলে আমি একগোছা ফুল নিয়ে নভেম্বরের এমন ভয়ংকর ঠান্ডা বিকেলে কেন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছি! আমন্ত্রণের উত্তরে পোস্টকার্ডটি ডাক বাক্সে ফেলা কি ভুল হয়েছিল?

আমরা যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাই তখন বাসে কয়েকজন মাত্র যাত্রী অবশিষ্ট ছিল। কিছুক্ষণ পর নির্দিষ্ট বাসস্টপে পৌঁছাই শুধু আমি এবং বাস ড্রাইভার। বাস থেকে নেমে পড়ি। আমন্ত্রণপত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢালু পথ ধরে হাঁটতে থাকি। যতবার আমি কোনো বাঁক পরিবর্তন করি ততবার একটা বন্দর দৃষ্টিসীমায় ধরা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছিল নিস্তেজ রঙে মøান, যেন সিসার আবরণে ঢাকা। বন্দরে সারি সারি ক্রেন দেখা যাচ্ছে, যা কতিপয় অদ্ভুক প্রাণীর অ্যান্টেনার মতো বাতাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং হামাগুড়ি দিয়ে সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ের ঢালুর বাড়িগুলো ছিল বৃহৎ এবং অত্যন্ত বিলাসবহুল। চতুর্দিকে চোখ-ধাঁধানো পাথরের দেয়াল, অত্যন্ত নান্দনিক গেট এবং দুটো গাড়ির গ্যারেজ। আজারিয়া ফুলের তৈরি দেয়াল চমৎকারভাবে ছাঁটা। শুনলাম কোথাও অনেকগুলো কুকুর সমস্বরে ডাকছে। কুকুরগুলো উচ্চৈঃস্বরে তিনবার ডাকার পর কে যেন তাদের থামিয়ে দিলো। এরপর চারপাশ একেবার নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেল।

আমি আমন্ত্রণপত্রের ম্যাপ অনুসরণ করে এগোচ্ছিলাম। তবে কেবলই মনে হচ্ছিল, কোথাও যেন বাঁধা পড়ে যাচ্ছি। প্রথমত, রাস্তায় কোনো জনমানবের দেখা মিললো না। বাস থেকে নামার পর থেকে আমি একটি পথচারীও দেখলাম না। কেবল দুটো কার চলে গেল পাহাড়ি ঢালুপথ বেয়ে নিচের দিকে। যদি এখানে কোনো পিয়ানো কনসার্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে তাহলে তো অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। প্রতিবেশীদের মধ্যেও বিরাজ করছে নীরবতা। যেন ওপরের মেঘগুলো সমস্ত সরব শব্দ গিলে ফেলছে।  

আমার কি বুঝতে ভুল হয়েছে?

আমি পকেট থেকে আমন্ত্রণপত্রটি বের করে আবার দেখে নিলাম। সম্ভবত সেটি ভুল পড়ে থাকতে পারি। খুব সতর্কভাবে পুরো আমন্ত্রণপত্রে চোখ বুলিয়ে নিলাম, কোনো ভুল চোখে পড়লো না। ঠিক বাস স্টপে নেমে সঠিক রাস্তায় এসেছি, সময় এবং তারিখ সবই ঠিক আছে। নিজেকে হালকা করার জন্য একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্থির হয়ে বসলাম। তবে আমি ঠিকঠাক কনসার্ট হলটি দেখতে পেয়েছি। দেখলাম ভবনটির সম্মুখে বিশালকায় স্টিলের গেটে একটা তালা ঝুলছে। মোটা একটি চেইন পেঁচিয়ে আছে গেটে, তাতে ঝুলছে তালা। আশেপাশে কাউকে দেখা গেল না। গেটের একপাশে কিঞ্চিত খোলা। পেছনে গাড়ি পার্কিং এলাকা; কিন্তু সেখানে একটাও গাড়ি পার্ক করা নেই। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হালকা ঘাস গজিয়েছে। পার্কিং এলাকাটি দেখে মনে হলো, তা আর ব্যবহার হয় না। তবে হলের সম্মুখে ঝুলে থাকা বিশাল সাইনবোর্ড বলে দিচ্ছি এটিই সেই অনুষ্ঠানের স্থান, যেটি আমি খুঁজছিলাম।

আমি গেটের পাশে রাখা ইন্টারকমে বারকয়েক চাপ দিলাম। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার ইন্টারকম বাজালাম, এবারো কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। ঘড়ির দিকে তাকালাম। অনুষ্ঠান শুরু হতে আর পনেরো মিনিট বাকি; কিন্তু অনুষ্ঠানের জন্য গেট খোলার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। জংধরা গেট থেকে রং খসে খসে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো – আরো একবার ইন্টারকমে চাপ দিলাম। এবার চাপ দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাখলাম; কিন্তু ফলাফল একই – কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। চতুর্দিকে গভীর নীরবতা।

বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করবো। গেটের সঙ্গে হেলান দিয়ে প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার আশা ছিল, কেউ একজন হয়তো আসবে; কিন্তু কেউ এলো না। ভেতরে বাইরে কোথাও কোনো জনমানবের আসা-যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। এমনকি সেখানে বাতাস পর্যন্ত নেই। কোনো পাখি কিংবা কুকুরের ডাকও শোনা গেল না। আগের মতোই থান থান ধূসর মেঘের কম্বলে ঢেকে আছে সব।

অবশেষে আশা ছেড়ে দিলাম; কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কী করবো? দ্রুত পায়ে ঢালুপথ বেয়ে বাসস্টপের দিকে হাঁটতে থাকি। কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, সব কেমন যেন কুয়াশাচ্ছন্ন। তবে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম যে, সেখানে কোনো পিয়ানো কনসার্ট বা অনুষ্ঠান নেই। আমি লাল ফুলের তোড়াটি হাতে নিয়ে বাড়িমুখী যাত্রা শুরু করি। মা আমাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে, ফুলগুলো কেন? ঠিক করি, ফুলগুলো স্টেশনের বিনে ফেলে দেবো। যদিও ফুলগুলো আমার কাছে ছিল অমূল্য।

পাহাড়ের পাদদেশে দেখতে পেলাম একটি ছোট্ট গোছানো পার্ক। আকারে একটি বাড়ির মতো। পার্ক থেকে কিছুটা দূরে এবং রাস্তার অদূরে ছিল কোনাকৃতি একটি প্রাকৃতিক শিলাপ্রাচীর। শুধুই একটি পার্ক, সেখানে ছিল না কোনো জলের ফোয়ারা কিংবা খেলাধুলার সরঞ্জাম। পার্কের মাঝখানে ছিল অনেকটা ডুব দেওয়া ছোট একটি বনকুঞ্জ। সেই বনের দেয়ালটি ঢাকা ছিল লতাগুল্মে। চারদিকে ছিল ঝোপঝাড়, সমতলে বিছানো ছিল হেঁটে যাওয়ার চারকোণা পাথর। বলা মুশকিল ছিল যে, কেন এই পার্ক তৈরি করা হয়েছে, তবে কেউ একজন এই পার্কের পরিচর্যা করে; গাছ এবং লতাগুল্মগুলো চমৎকারভাবে ছাঁটা, চারপাশে কোনো আগাছা বা আবর্জনা নেই। আমি পাহাড়ের উঁচুতে এ-পার্কের পাশ দিয়ে গেলেও খেয়াল করিনি।

নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে আমি পার্কের ভেতরে প্রবেশ করে বনকুঞ্জের পাশে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়ি। ঠিক করি, এই এলাকাটি সম্পর্কে ধারণা নিতে আরো কিছু সময় আমার সেখানে থাকা উচিত। বসার পরে বুঝতে পারলাম আমি কতটুকু ক্লান্ত। এ যেন অদ্ভুত এক ক্লান্তি, যা আমি এতোক্ষণ খেয়াল করিনি। বসার পরেই জগতের সব ক্লান্তি আমার ওপর চেপে বসলো। বনকুঞ্জের পাশ থেকে পরিষ্কার দেখা যায় বন্দর। কিছু বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরের জেটিতে নোঙর করেছে। পাহাড়ের ওপর থেকে জাহাজে থরে থরে রাখা কনটেইনারগুলোকে ছোট ছোট টিনের মতো মনে হচ্ছে, যেন টেবিলের ওপর কয়েন বা পেপার ক্লিপ রাখার পাত্র। 

কিছুক্ষণ পর অদূরে একটি পুরুষকণ্ঠ শুনতে পাই। সে-কণ্ঠ স্বাভাবিক নয়, সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে উচ্চশব্দে প্রচারিত। আমি বুঝতে পারিনি কী বলছিল, তবে প্রতিটি বাক্য উচ্চারণের পর একটু বিরতি দিচ্ছিলো এবং পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলছিল। কোনো রকম আবেগ ছাড়া, যেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়েছিল, সে-বার্তা আমাকে দেওয়া হচ্ছিল। আমার কোথায় ভুল ছিল তা যেন কেউ একজন বলার চেষ্টা করছে, যা আমি উপেক্ষা করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তা আর এমন কী; কিন্তু ঘটনাটি আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করেছিল। আমি একাগ্রচিত্তে শুনছিলাম সে-বার্তা। কণ্ঠটি উচ্চ কিন্তু স্থির হয়ে এলো, যা আমার পক্ষে বুঝতে সহজ হলো। কণ্ঠটি নিশ্চিত কারের ওপরে বাঁধা কোনো সাউন্ড বক্স থেকে আসছিল। কারটি ঢালুপথ বেয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম, একটি কার থেকে খ্রিষ্টান বার্তা প্রচার করা হচ্ছিল।

শান্ত কণ্ঠে বলছে, ‘সবাইকে একদিন মরতে হবে। প্রত্যেককে একদিন দেহত্যাগ করতে হবে। কেউ মৃত্যু এবং তার পরবর্তী সৃষ্টিকর্তার বিচার থেকে বাঁচতে পারবে না। প্রত্যেকে মৃত্যুর পর তার কৃতকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি হবে।’ 

আমি বেঞ্চে বসে সে-বার্তা শুনছিলাম। পাহাড়চূড়ায় এমন নির্জন এলাকায় কে এভাবে ধর্ম প্রচার করছে, তা ভেবে কিছুটা বিস্ময় জেগেছিল। এখানে যারা বসবাস করে প্রত্যেকে ধনী, এক-একজনের

গাড়ি আছে কয়েকটা। আমার মনে হলো, তারাই হয়তো পাপ থেকে মুক্তি চাইছিল, অথবা তারা কি পাপী ছিল? তাদের

আয় এবং জীবনযাপন পাপ ও পরিত্রাণ যোগ্য নয়!

‘যারা যিশুখ্রিষ্টের মধ্যে মুক্তি খুঁজছে এবং নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছে, তাদের ঈশ্বর ক্ষমা করবে। তারা নরকের আগুন থেকে বেঁচে যাবে। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখো, শুধুমাত্র এই জন্যেই ঈশ্বরবিশ্বাসীরা মৃত্যুর পর ক্ষমা পাবে এবং অমরত্ব লাভ করবে।’

আমি খ্রিষ্টান মিশনারি কারটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবং আরো শুনতে চাইছিলাম মৃত্যুর পর কী বিচার হবে। মনে করেছিলাম, আশ্বস্ত হওয়ার মতো আরো কিছু কথা শুনবো, স্থিরকণ্ঠে, কোথা থেকে বলছে, সেটা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু না, কারটি আমার চোখে পড়লো না। একসময় সেই কণ্ঠ ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছিল, কিছুক্ষণ পর আর কিছুই শুনতে পেলাম না। গাড়িটি আমি যেখানে আছি সেখান থেকে হয়তো উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছে। গাড়িটি মিলিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো, পৃথিবী যেন আমাকে বিসর্জন দিয়েছে।

হঠাৎ নিজের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগলো, সম্ভবত এই গোলকধাঁধা ওই মেয়েটিই তৈরি করেছে। এই পরিকল্পনা অন্য কোথাও থেকে আসছে না। যে-কোনো কারণে আমি জানতে পারিনি, মেয়েটি আমাকে একের পর এক ভুল তথ্য দিয়ে রোববার বিকেলে টেনে এই দুর্গম পাহাড়চূড়ায় উঠিয়েছে। হয়তো এমন কিছু করেছি যার ফলে আমার বিরুদ্ধে তার মনে ক্ষোভ জমেছে। অথবা হতে পারে বিশেষ কোনো কারণ নয়, আমাকে সে অতিশয় নিরস মানুষ হিসেবে পেয়েছে, যা সে আশা করেনি। তাই সে আমাকে অনুষ্ঠানের নাম করে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে এখন মজা নিচ্ছে। হয়তো সে এখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে বা আন্দাজ করছে আমি কোন পরিস্থিতিতে পড়েছি – সে আমাকে কতটুকু বোকা বানিয়েছে, আর এ-পরিস্থিতিতে পড়ে আমাকে কতটুকু করুণ এবং হাস্যকর দেখাচ্ছে।

একজন ব্যক্তি কীভাবে আরেকজনকে বিপাকে ফেলার জন্য এতো জটিল পরিকল্পনা করতে পারে, ভেবে পাচ্ছি না। আমন্ত্রণপত্র ছাপার জন্যও তো তাকে সময় দিতে হয়েছে। এমন করার কী কোনো মানে হয়? মেয়েটি আমার ওপর ক্ষেপে থাকার মতো কোনো কাজ করেছি বলে কোনোমতেই মনে পড়ে না। তবে কোনো কোনো সময় এমনও হয়, আমরা না বুঝেই অন্যের অনুভূতির ওপর আঘাত করি, তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি, তাদের মন খারাপের কারণ হই। আমি অযাচিত ঘৃণার আশঙ্কাও করছি, হয়তো কোনো একটা ভুল বোঝাবুঝি আমাদের হয়েছিল, তবে সঠিক কোনো কিছুই আমি মনে করতে পারছি না। নিরর্থক আবেগের এক গোলকধাঁধায় আমি ঘুরে ফিরছি। মনে হচ্ছে, আমার অনুভূতি গতি হারাচ্ছে। এমন মনে হওয়ার আগে আমি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলাম।

প্রতিবছর দু-একবার আমার এমন হয়। মনে হয়, তা ছিল মানসিক চাপে সৃষ্ট শ্বাসকষ্ট। কিছু একটা আমাকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে, গলা শুকিয়ে আসছে এবং বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি আতংকিত হয়ে পড়ি, যেন প্রচণ্ড স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম, জমে যাচ্ছিল শরীর। সেই সময় আমি মাথা গুঁজে বসে, চোখ বন্ধ করে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার শরীর স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এ-উপসর্গ কেটে গেল (কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি নিজেই একে রোধ করতে সমর্থ হই) যদিও কৈশোরে এ সমস্যা আমাকে অনেক ভুগিয়েছিল।

আমি কুঞ্জবনের পাশে বেঞ্চিতে স্থির দৃষ্টি রেখে উপুড় হয়ে বসে থাকি এবং সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। এভাবে হয়তো পাঁচ মিনিট কিংবা পনেরো মিনিট ছিলাম। ঠিক বলতে পারবো না কত সময় ছিলাম। পুরো সময় দেখতে পেলাম অদ্ভুত কিছু একটা চোখের সম্মুখে আসছে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। ধীরে সেগুলো গুনতে থাকলাম এবং নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলাম। আমার হৃদস্পন্দন পাঁজরের ভেতর দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে, যেন আতংকগ্রস্ত কোনো ইঁদুর ভেতরে দাপাদাপি করছে।

আমি অদ্ভুত সেই বস্তুটি খুব সতর্কতার সঙ্গে গুনছিলাম, ফলে অন্য কেউ একজন যে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তা টের পেতে কিছুটা সময় লাগলো। মনে হলো, কেউ সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সাবধানে, ধীরে ধীরে চোখ খুলে মাথা তুললাম। তখনো আমার অস্বাভাবিক রকম হৃদকম্পন হচ্ছিল। অলক্ষ্যে এক বৃদ্ধ লোক বেঞ্চির প্রান্তে বসে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো তরুণের পক্ষে একজন বয়োবৃদ্ধ লোকের বয়স নির্ণয় করা অতো সহজ নয়। আমার কাছে তারা সবাই বৃদ্ধ লোক। ষাট, সত্তর – কী পার্থক্য তাতে? তারা তো আর তরুণ নয়, সেটাই আমার কাছে বিবেচ্য। লোকটি পরেছে নীল-ধূসর রঙের একটি উলের কার্ডিগান, কড কাপড়ের বাদামি প্যান্ট এবং আকাশি-নীল রঙের এক জোড়া জুতো। তার পরনের পোশাক নতুন না পুরনো তা বুঝতেও চলে গেল কিছু সময়। এমন নয় যে তিনি নোংরা বা সেরকম কোনো পোশাক পরেছেন। তার ধূসর-ঘন চুল ছিল বেশ খাড়া। পাখি স্নান সারার পর ডানা দুটি যেভাবে মেলে ধরে টিক সেরকম লোকটির দুই কানের ওপর চুলগুলো খাড়া হয়ে আছে। তার চোখে কোনো চশমা ছিল না। জানি না লোকটি সেখানে কতক্ষণ ধরে অবস্থান নিয়েছে। আমার ধারণা, অনেক আগে থেকেই সে আমাকে লক্ষ করছে।

নিশ্চিত ছিলাম লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি ঠিক আছো?’ বা সেরকম কিছু। কারণ দেখেই মনে হতে পারে যে, আমি বিপাকে আছি (আমি ছিলামও তাই)। লোকটিকে দেখে আমার প্রথমে এমনটিই মনে হয়েছিল। কিন্তু লোকটি কিছুই বলেনি, জিজ্ঞেসও করেনি কিছু, শুধু শক্তভাবে লাঠির মতো ধরে আছে একটি ছাতা। ছাতাটির পীতাভ তৈলস্ফটিক রঙের একটি কাঠের হাতল রয়েছে, যা প্রয়োজন হলে যেন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তার সঙ্গে যেহেতু আর কিছুই ছিল না, তাই আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, লোকটি এ-পাড়ারই বাসিন্দা।

আমি সেখানে বসে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছিলাম। বুড়ো লোকটি নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একবারের জন্যও চোখের পলক ফেলেনি। আমি তাতে অস্বস্তি বোধ করছিলাম, যেন কারো বাড়ির পেছনের উঠোনে অনুমতি ছাড়া ঘোরাঘুরি করছিলাম। চেষ্টা করছিলাম বেঞ্চ থেকে উঠে যত দ্রুত সম্ভব বাস স্টপে গিয়ে পৌঁছতে। কিন্তু কেন যেন সেখান থেকে এক পাও এগোতে পারলাম না। সময় যাচ্ছে, এমন সময় বুড়ো বলে উঠলো –

‘একটি বৃত্তের মধ্যে অনেক কেন্দ্র।’

আমি তার দিকে তাকালাম। চোখাচোখি হলো। প্রশস্ত তাঁর কপাল, টিকালো তাঁর নাক। পাখির ঠোঁটের মতো শাণিত। আমি কিছুই বলতে পারিনি। তাই বুড়ো আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন – ‘একটি বৃত্তের মধ্যে অনেক কেন্দ্র।’

প্রকৃতই আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তিনি কী বলতে চাইছিল। এসময় মনে হলো, এই লোকটিই খ্রিষ্টের বাণী প্রচারকারী সেই মাইকসহ কারটি চালাচ্ছিল। পাশে কোথাও গাড়ি পার্ক করে এখানে বসেছেন বিশ্রাম নিতে। আবার মনে হলো, না তা হতে পারে না। আমি যার গলা শুনেছিলাম মাইকে, তার কণ্ঠ আর এই বুড়োর কণ্ঠ এক নয়। সেই কণ্ঠ কোনো এক তরুণের ছিল। অথবা হতে পারে, সে-কণ্ঠ রেকর্ড করা ছিল।

‘আপনি কি বলেছেন, বৃত্ত?’ অনেকটা অনিচ্ছায় আমি জিজ্ঞেস করি। তিনি আমার চেয়ে অনেক বয়স্ক, তাই খুব ভদ্রভাবেই জানতে চাইলাম।

‘সেখানে অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে – না, কখনো কখনো এ-সংখ্যা অসীম। এবং এটি রহস্যাবৃত বৃত্ত।’ একথা বলেই বুড়ো ভ্রু কুঁচকালো – কপালে গভীর ভাঁজ। ‘তুমি কি নিজের চিন্তায় এমন কোনো বৃত্ত দেখতে পাও?’

আমি তখনো ধাতস্থ হইনি, তবে তাঁর কথা গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলাম। একটি বৃত্ত, তার অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে; কিন্তু তার কোনো বেষ্টনী নেই। আমি এ-বিষয়ে কিছুই কল্পনা করতে পারছিলাম না।

‘আমি কিছু বুঝিনি’, বললাম।

বৃদ্ধ নীরবে আমার দিকে তাকালেন। সম্ভবত এর চেয়ে ভালো কোনো উত্তর আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিলেন।

‘গণিতের ক্লাসে এ-ধরনের কোনো বৃত্তের বিষয়ে আমাদের পড়ানো হয়েছে, এমন মনে পড়ে না’, আমি দুঃখিত – এমন ভাব নিয়ে কথাকটি যুক্ত করলাম।

বৃদ্ধ ধীরে মাথা নাড়লেন। ‘অবশ্যই না। যদিও তা প্রত্যাশিত ছিল। তারা তোমাকে এ-ধরনের কোনো গণিত শিক্ষা দেয়নি। তুমি তা ভালোই জানো।’

আমি ভালো জানি? কেন লোকটি এভাবে অনুমান করছেন?

‘সত্যিই কি এ-জাতীয় বৃত্ত বিদ্যমান?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘অবশ্যই বিদ্যমান’, কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বুড়ো বললেন। ‘এই বৃত্ত আসলেই বিদ্যমান। কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না – তুমি জানো।’

‘আপনি কি তা দেখতে পান?’

বুড়ো কোনো উত্তর দেন না। আমার প্রশ্নটি বেয়াড়ার মতো কিছুক্ষণ ঝুলে

থাকলো এবং একসময় ধোঁয়াশা হয়ে মিলিয়ে গেল।

বুড়ো আবার কথা বলে উঠলেন, ‘শোনো নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে তোমাকে তা অনুমান করতে হবে। তোমার সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে তাকে দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। একটি বৃত্ত যার অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে; কিন্তু আয়তন নেই। তুমি এমন নিবিড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও, রক্তঘাম ঝরাও, দেখবে বৃত্তটি ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠছে।’

‘বিষয়টি খুব জটিল মনে হচ্ছে’, আমি বললাম।

‘অবশ্যই জটিল’ – বুড়ো বললেন। এমনভাবে বললেন মনে হলো, শক্ত কোনো কিছু যেন মুখ থেকে বের করছেন।

‘পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যে যা সহজে তুমি পেতে পারো।’ তারপর নতুন কিছু বলার জন্য খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। ‘কিন্তু তুমি যদি এর পেছনে সময় এবং প্রচেষ্টা অব্যহত রাখো, এবং জটিল বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারো, তাহলে তা তোমার জীবনের সেরা অর্জন (ক্রিম) হয়ে উঠবে।’

‘ক্রিম?’

‘ফ্রান্সে একটি শ্লোক আছে ‘ক্রিম দে লা ক্রিম’, তুমি জানো সেটা?’

বললাম, ‘জানি না। আমি ফ্রেঞ্চ জানি না।’

‘ক্রিমের ক্রিম। মানে ভালোর চেয়ে ভালো। এটাই জীবনের গূঢ় সারকথা – সেটা হচ্ছে ‘ক্রিম দে লা ক্রিম। বুঝতে পেরেছো? আর বাকি সব বিরক্তিকর এবং অর্থহীন।’

আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না যে, ‘ক্রিম দে লা ক্রিমে’র মধ্যে বুড়ো কী পেয়েছেন?

‘এ-বিষয়ে চিন্তা করো’, বুড়ো বললেন। ‘আবার তোমার চোখ বন্ধ করো, গভীরভাবে চিন্তা করো। একটি বৃত্ত যার অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে; কিন্তু আয়তন নেই। তোমার মস্তিষ্ককে কঠিন বিষয়ে চিন্তা করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে, যা তোমাকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাবে, তাতে তুমি যা বুঝতে পারছো, তা প্রথমে বুঝতে পারোনি। তুমি অলসতা কিংবা অবহেলা করতে পারো না। ঠিক, এখন খুব সংকটাপন্ন সময়। কারণ এটা হচ্ছে তোমার মস্তিষ্ক এবং হৃদয়কে একীভূত করার সময়।’

আমি চোখ বন্ধ করে আবার সেই বৃত্তটিকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করলাম। আমি অলস কিংবা অবহেলাকারী হতে চাই না। তবে লোকটি কী বলছেন, তাকে আমি কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি, তা বিবেচ্য বিষয় নয়; কিন্তু তিনি কী বলছেন তার অর্থ সে-সময় আমার পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিল। আমি জানি, বৃত্তের একটি কেন্দ্র আছে এবং বাঁকানো একটি পরিধি পুরো বৃত্তকে একটি কেন্দ্রে স্থাপন করে। কম্পাস দিয়ে এমন একটি সাধারণ চিত্র আঁকা যায়। বৃত্ত তো এমনই, কিন্তু বুড়ো বৃত্তের বাইরে কথা বলছিলেন কেন? মানে আয়তন নেই কেন বলছেন?

একবারও ভাবিনি যে বুড়ো মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। এও ভাবিনি যে, লোকটি আমাকে খেপানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা আমাকে বলতে চাইছেন। অতএব আমি আবার বোঝার চেষ্টা করলাম; কিন্তু আমার মন কেবল চতুর্দিকে আকুলি-বিকুলি করলো, বুঝতে পারলো না কিছুই। কীভাবে অনেক কেন্দ্র রয়েছে (বা সম্ভবত অসংখ্য) এমন বৃত্ত একটি বৃত্তে উপস্থিত হতে পারে? এটি কি কোনো পরিণত দার্শনিক রূপক ছিল? আমি হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ খুললাম। বোঝার জন্য আমার আরো সূত্র বা ইঙ্গিত দরকার।

কিন্তু বুড়ো লোকটিকে আর দেখা গেল না। আমি চতুর্দিকে তাকালাম, পার্কে কারো অবস্থানের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। মনে হচ্ছিল, এখানে কেউ ছিলই না। আমি কি পুরো বিষয়টি কল্পনা করেছিলাম? না, অবশ্যই তা কোনো কল্পনা ছিল না। লোকটি আমার সামনেই ছিল, হাতে শক্ত করে ধরা ছিল একটা ছাতা, শান্তভাবে কথা বলছিলেন, একটি অদ্ভুত প্রশ্ন উত্থাপন করলেন এবং মিলিয়ে গেলেন!

এতোক্ষণে বুঝতে পারি আমার হৃদকম্পন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, শান্ত এবং স্থির। মানসিক চাপ কমে এসেছে। বন্দরের ওপরে শূন্য আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে যাচ্ছিলো। এক চিলতে আলোকরশ্মি ক্রেনের ওপরে রুপোলি ধাতু নির্মিত ঘরের ওপরে পড়েছে। সেই আলো নির্দিষ্ট কোনো একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এগোচ্ছে। আমি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম, মনে হলো তা একটি পৌরাণিক দৃশ্যে রূপ নিল।

জরি কাগজে মোড়ানো একগুচ্ছ লাল ফুল আমার পাশেই ছিল। যেন এতোক্ষণ যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল তার সাক্ষী হয়ে রইলো। আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, কী করবো এ ফুল দিয়ে? বরং তা কুঞ্জবনের বেঞ্চে রেখে দিয়ে সে-পর্ব শেষ করলাম। সেটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে সময়োপযোগী। উঠে দাঁড়ালাম এবং হাঁটতে শুরু করলাম বাসস্টপের দিকে, যেখানে নেমে আমি এখানে এসেছিলাম। প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করেছে। ছুটতে শুরু করেছে স্তূপাকৃতি মেঘ।

গল্পটা বলা শেষ হওয়ার পর আমি একটু থামি। তারপর আমার তরুণ বন্ধু বলে ওঠে – ‘আমিও আসলে কিছু বুঝতে পারিনি। আসলেই কী হয়েছিল? কার্যত সেখানে কি কোনো নীতি বা উদ্দেশ্য ছিল?’

শরতের শেষের দিকে রোববার বিকেলে কোবে পর্বতচূড়ায় আমি এমনসব অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলাম। একটি আমন্ত্রণপত্র অনুসরণ করে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু আবিষ্কার করলাম জনমানবহীন একটি ভবন – এসব ঘটনার মানে কী? কেন এসব ঘটেছে? আমার বন্ধু এসব জিজ্ঞেস করছিল। একেবারে স্বাভাবিক প্রশ্ন। বিশেষত আমি তাকে যে-গল্প বলেছি তার কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারিনি।

স্বীকার করলাম, ‘আমি নিজেও সে-ঘটনা বুঝতে পারিনি, এমনকি এখনো নয়।’

যা অমীমাংসিতই রয়ে গেল, অনেকটা প্রাচীন ধাঁধার মতো। সেদিন যা ঘটেছিল তা অবর্ণনীয় এবং অনধিগম্য। আঠারো বছর সে-ঘটনা আমাকে বিস্ময় ও রহস্যের মধ্যে ঠেসে রেখেছিল।

‘তবে আমি অনুভব করেছি’, বললাম, ‘সেই ঘটনার উদ্দেশ্য বা বিধেয় তেমন কোনো বিষয় ছিল না।’

আমার বন্ধু কিছুটা বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে বললো, ‘তার মানে তুমি বলছো, কেন ওই অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল তার সম্পর্কে কিছুই জানার দরকার নেই?’

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম।

সে বললো, ‘যদি তোমার জায়গায় আমি হতাম তাহলে অবশ্যই এর শেষ জানতে না পারাটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতো। আমি এর সত্য জানতে চাইতাম, কেন এমন ঘটনার অবতারণা হলো।’

অবশ্যই, বিষয়টি আমাকেও অস্বস্তিতে রেখেছে। অনেক। ঘটনাটি এখনো আমাকে রীতিমতো আঘাত করে। তবে পরে ভেবে দেখলাম, অনেক সময় পার হয়ে গেল, ঘটনাটিও স্মৃতিতে অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে, সেটা নিয়ে হতাশ হওয়াটা বুদ্ধির কাজ হবে না। আমি ভাবলাম, জীবনের সুবর্ণপ্রাপ্তির (ক্রিম) সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

‘জীবনের ক্রিম’ – সে পুনরুচ্চারণ করলো।

তাকে বললাম, ‘এমন ঘটনা কোনো কোনো সময় ঘটতে পারে। অবর্ণনীয়, অযৌক্তিক ঘটনাগুলো খুব বিরক্তিকর। বরং আমরা এ-বিষয়ে আর না ভাবলেই ভালো। চোখ বন্ধ করে সে-ঘটনাগুলো অনুভব করো। ঠিক আমরা যেভাবে বিশাল বিশাল ঢেউ ঠেলে এগোই।’   

আমার তরুণ বন্ধু কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলো, অনুভব করলো সেই ঢেউ। সে অবশ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দক্ষ ছিল। ও এমন আরো অনেক জটিল বিষয় মোকাবিলা করেছে, যা প্রচণ্ড ঢেউয়ের মতো তেড়ে আসে। অবশেষে সে বলে, ‘তবে কোনো বিষয়ে চিন্তা না করাটাও বেশ কঠিন হতে পারে।’

‘ঠিক বলেছো, তাও কঠিন হতে পারে।’

‘এই পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা তুমি সহজে পেতে পারো।’ বুড়ো লোকটি বলেছিলেন, অদম্য বিশ্বাসের সঙ্গে। ঠিক পিথাগোরাস তাঁর উপপাদ্য যেভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেভাবে।

‘সেই বৃত্তের অনেকগুলো কেন্দ্র ছিল; কিন্তু কোনো আয়তন ছিল না’, আমার বন্ধু বললো, ‘এর কোনো অর্থ তুমি খুঁজে পেয়েছো?’

‘ভালো প্রশ্ন।’ আমি বললাম। ধীরে মাথা উঁচু করলাম। সত্যিই আমি কি কোনো উত্তর খুঁজে পেয়েছিলাম?

আমার জীবনে যখনই অনির্বচনীয়, অযৌক্তিক ও বিরক্তিকর ঘটনা ঘটে (বলছি না যে সব সময় ঘটে, কখনো কখনো ঘটে), সবসময় আমি ফিরে আসি সেই বৃত্তের কাছে – একটি বৃত্ত, যার অনেকগুলো কেন্দ্র আছে; কিন্তু কোনো আয়তন নেই। তাই করি যা আমি আঠারো বছর বয়সে করেছিলাম, বনকুঞ্জের পাশে বেঞ্চিতে বসে। চোখ বন্ধ করি আর হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনি।

কখনো কখনো আমি উপলব্ধি করতে পারি কী সেই বৃত্ত; কিন্তু এর গভীর মর্মার্থ আমাকে থামিয়ে দেয়। সম্ভবত এটি মূর্ত কোনো বৃত্ত নয়, সত্যিকারের গঠন; কিন্তু এটি কেবল বিদ্যমান আমাদের মস্তিষ্কে। যখন আমরা কাউকে গভীর ভালোবাসি, অথবা কারো জন্য গভীর সমবেদনা অনুভব করি, বা পৃথিবী কেমন হওয়া উচিত – সেরকম ভাববাদী হয়ে উঠি, কিংবা আমরা যখন আবিষ্কার করি বিশ্বাস (বা বিশ্বাসের কাছাকাছি কিছু) – তখন আমরা কেন্দ্রকে ধরতে পারি ও নির্দিষ্ট করে তাকে হৃদয়ে ধারণ করি। স্বীকার করি, যদিও এটি আমার স্পষ্টতার বিপরীতে যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

‘তোমার মস্তিষ্ককে কঠিন বিষয়ে চিন্তা করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে, যা তোমাকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাবে, তুমি যা বুঝতে পারছো, তাই যা প্রথমে বুঝতে পারোনি। আর এটিই তোমার জীবনের সফলতা (ক্রিম)। বাকি সব বিরক্তিকর ও অর্থহীন।’ এই কথাগুলোই ধূসর চুলের বুড়ো লোকটি আমাকে বলেছিলেন। শরতের শেষে এক রোববার মেঘাচ্ছন্ন বিকালে, কোবে পাহাড়চূড়ায়; আমার হাতে ছিল একগুচ্ছ লাল ফুল। এমনকি এখনো, যদি আমার বিরক্তিকর কোনো কিছু ঘটে, আমি আবার বিশেষ করে সেই বৃত্তটিকে চিন্তা করি, বিরক্তিকর এবং অর্থহীন। অনন্য সেই ‘ক্রিম’ প্রোথিত আছে আমার গভীরে।

[অনুবাদকের কথা : সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির (১৯৪৯) আটটি গল্পের সংকলন ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার (মূল জাপানি ভাষায় গ্রন্থের শিরোনাম – ইছিবানসু তানসু)। মূল জাপানি ভাষা থেকে সবকটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে মুরাকামির গল্পগ্রন্থটি ব্যাপক আলোচিত। বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সব সাহিত্যপত্রিকা গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। এখনো দি নিউ ইয়র্কার, গার্ডিয়ান, দি টাইমস থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সংগীত, স্মৃতি এবং স্ফীত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসিক দর্শন গল্পগুলোর অবকাঠামো তৈরি করেছে। এ-গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ক্রিম’। ইংরেজি থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করার সময় যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল মূলের ভাব ও চিন্তার রেখা ঠিক রাখা।]

মুল লেখা নেয়া হয়েছে কালি ও কলম থেকে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য