রাত ১টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এক রুমে সাদিক, রিপন, লিয়ন থাকত। হলের বাম পাশে ছিল বিশাল আমবাগান। বাগানের পাশ ঘেঁষেই চলে গেছে রাস্তা। তিন বন্ধুরই গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা অভ্যাস। সাদিকের মাঝে মাঝেই গভীর রাতে চা’য়ের নেশা ওঠে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। বাগানের শেষ মাথায় রশিদ চাচার দোকান। গভীর রাত পর্যন্ত এ দোকান খোলা থাকে। কিন্তু আজ বন্ধ। চায়ের নেশায় কারোর মনেই ছিল না যে আজ শুক্রবার। মেঘের কারনে পুরনিমা থাকলেও চারপাশে হালকা অন্ধকার ছিল। উপয়ন্তর না দেখে দোকানের সামনের টং এ বসে পড়ল। রিপনের সঙ্গে সব সময় একটা সিগারেটের প্যাকেট আর দিয়েসেলাই থাকত। রিপন সিগেরেট ধরাল আর তা নিঃশেষ হল তিন জনের ভাগাভাগিতে! হঠাৎ করেই লিয়নের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ও বলল, চল আম বাগানে ঢিল ছুরি, দেখি কারটা দূরে যায়, দারোয়ান ব্যাটা আসলে দৌড় দিলেই চলবে। তিন জনের কারোর ঢিলই বেশিদূর যেতে পারল না। টঙে বসে আবার তিন জনে সিগারেট টানাটানি। হঠাৎ রশিদ চাচার দোকানের ভেতর সড় সড় শব্দ হতে লাগল। ‘’টিনের দোকান তাই ধেড়ে ইদুর ভেতরে একটু হলি খেলছে আরকি’’ এই বলে লিয়ন হালকা হাসি দিল। কেউ গায়ে লাগালনা। কিন্তু শব্দটা যখন ক্রমশ জোরে হতে লাগল তখন তিন জনই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। সবার বুকেই ভয় ঢুকতে শুরু করেছে। কিছুক্ষন পর বিনা বাতাসেই দোকানের উপরের বটের গাছটা সজোরে ঝুঁকতে শুরু করল। ভূমিকম্প হলে যেমন হয়। এবার তিনজনই ভুত ভুত বলে দিল ভোঁদৌড়। যে আমবাগান হেটে পেরুতে গেলে লাগে দশ মিনিট সেই বাগান পেরিয়ে হলের রুমে গিয়ে পৌঁছল দুমিনিটে।
লিয়ন আর রিপন যখন হাঁপাচ্ছিল তখন সাদিককে খুবই চিন্তিত দেখা গেল। লিয়ন বলছিল জোর বাচা বেঁচে গেছিরে। আর কিছুক্ষন টঙে থাকলে মনেহয়না ভুতেরা আমাদের ছেড়ে কথা বলত। রিপন বলে উঠল নে সিগেরেট লাগা। সিগেরেট ব্যচেলরদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ ! এবার দুজনই হেসে উঠল। কিন্তু সাদিকের সেদিকে খেয়াল নেই। সে বলে উঠল, তোরা বটের গাছের দিকে তাকিয়েছিলি? রিপন বলে উঠল, আরে ব্যাটা সে সময় আর পেলাম কই? জীবন নিয়েই টানাটানি। সাদিক বলল, গাছটায় কেউ একজন ছিল। যে আমাদের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ছিল। আমি স্পষ্ট দেখেছি, একটা সাদা সিল্কের জামা পড়া মেয়েদের মত, বট গাছে…। রিপন বলল, কি আজেবাজে বলছিস এসব, চল ঘুমিয়ে পড়ি। ভয়ের ঠ্যালায় তিন জনই জড়াজড়ি করে একই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সাদিকের ঘুম আসছিল না। মাঝ রাত্তিরে সাদিক দেখল রুমটা আলোয় ভরে গেছে। তখন বাকী দুজন ঘুমচ্ছে।
সাদিক ভয় পেয়ে যায়। আলোটা আসছিল রুমের জানালা দিয়ে। তার হাত পা কাঁপছিল। তবুও সাহস করে জানালার দিকে যায়। রুমের সাথেই ছিল আমবাগান। সাদিক সাহস করে জানলা দিয়ে আমবাগানের দিকে তাকায়। তার হাত এবং পা তখনও সজোরে কাঁপছিল। কিন্তু আমবাগানের দিকে তাকাতেই তার ভয়ের মাত্রা ৪৫০ ভোল্টেজ এ ওঠে। সাদিক স্পষ্ট দেখতে পেল শুভ্র সিলকের জামা পড়া একটা মেয়ে আম বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। আলোটা তার শরীর থেকেই আসছে। পুরো বাগান আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। মেয়েটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। তার চুলগুলো অনেক লম্বা। সাদিকের বুঝতে আর বাকী রইল না এটা রশিদ চাচার সেই বট গাছের ভুত। সাদিক এবার চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে জানালাটা বন্ধ করার চেষ্টা করে। তার হাত প্রচণ্ড রকম কাঁপছিল। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে যদি ভুতে হাত টেনে ধরে এই ভয়েই সে জানালা বন্ধ না করেই খাটে শুতে যায়। রিপন আর লিয়ন একজন আরেকজনের গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। সাদিক ওদের ডাকতে থাকে। গা ধরে নাড়াতে থাকে। কিন্তু ওদের ঘুম আর ভাঙে না। সাদিকের মনে হচ্ছিল দুটোরই পশ্চাৎ দেশে সজোরে লাথি মেরে ঘুম থেকে তুলতে কিন্তু ভুতের ভয়ে সেটাও আর হচ্ছে না। সাদিক ওদের পাশে শুয়ে যায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করতে পারে না। যদি চোখ বন্ধ করলেই ভুতটা জানালা দিয়ে রুমে চলে আসে। এবার সাহস করে চোখ বন্ধ করে। কিন্তু প্রচণ্ড আলো তার চোখে এসে লাগছিল। চোখ খলেতেই তার জীবন যাওয়া অবস্থা। চোখ খুলতেই সে দেখতে পায় পরীটা রুমে চলে এসেছে। সাদিকদের খাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাদিক ভয়ে ভুত ভুত বলে চিৎকার করে। কিন্তু মনে হচ্ছিল কেউ তার কণ্ঠ ধরে আছে। তার গলা দিয়ে শুধু ভু…উ…ত শব্দটা ফোস ফোঁস করে বেরুতে থাকে। সাদিক রিপনের শার্ট ধরে ঝকাতে থাকে। কিন্তু রিপন ঘুমের ভেতরেই সাই করে সাদিকের পশ্চাৎ দেশে লাথি মেরে বলে ‘’ব্যাটা ঘুমাতে দে’’। পরীটা এবার চোখ লাল লাল করে সাকিককে জিজ্ঞেস করে, এই ছেলে তোমার সাহস কি করে হয় ঢিল ছুড়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে দেয়ার। সাদিক এবার কাপতে কাপতে উত্তর দেয়, বিশ্বাস করুন আমি আম গাছে ঢিল ছুড়েছি। পরীটা উত্তর দেয়, ওই আম গাছেই আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। তুমি আমার ঘুম ভেঙ্গে দিয়েছ আমি তো তোমায় ঘুমাতে দিতে পারিনা। বলেই হেসে ওঠে। সাদিক ভয়ে কাপা কাপা কণ্ঠে উত্তর দেয়, বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে ঢিল ছুরিনি। আমি জানতাম না আপনি ওই গাছে ঘুমান। পরীটা এবার বলে, আচ্ছা এবারের মত ক্ষমা করে দিলাম। আমার নাম ক্রেডাং। তোমার? সাদিক উত্তর দেয়। পরীটা এবার বলে, আমার বন্ধু হবে? সাদিক ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয় হ্যা…। যদি না বললে ঘার মটকে দেয় এই ভয়েই সাদিক হ্যা বলে না হলে কেউ কি আর সখ করে ভুতের বন্ধু হতে চায়। মেয়েটা এবার সাদিককে বলে, তুমি ঘুমিয়ে পর আমি বাকী দুটোকে দেখেছি। সাদিক কিছু বলার আগেই সাদিকের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ঘুমিয়ে পরে সে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই দেখে রিপন আর লিয়ন দুজনে মারামারি লাগিয়েছে। রিপন নাকি ঘুম থেকে উঠে দেখে ওর পরনে লুঙ্গি নেই। লুঙ্গি লিয়ন নিজের মাথার নিচে নিয়ে ঘুমিয়েছে। আর রিপন লিয়নের লুঙ্গি নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। ব্যাস শুরু হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সাদিক কোনভাবে যুদ্ধ বন্ধ করে রিপনকে প্রশ্ন করে আচ্ছা রিপনকে প্রশ্ন করে রিপন মানলাম লিয়ন তোর লুঙ্গি খুলেছে কিন্তু লুঙ্গি খুলে নিয়ে সে তার নিজের মাথার নিচে ঘুমতে কেন? আমার মাথার নিচে রেখে আমাকে তো ফাসাতে পারত? রিপন উত্তর দেয় তাহলে এটা কার কাজ হতে পারে? সাদিক বলে, ভুতের। কেন কালকের কথা ভুলে গেলি। আমরা আম বাগানে ঢিল ছুড়েছি আর ওই আমবাগানেই ছিল ভুত। লিয়ন প্রশ্ন করে কিন্তু বাগানে যে ভুত আছে সেটা তুই জানলি কিভাবে? সাদিক এবার ফাদে পরে। কিন্তু বুদ্ধি করে উত্তর দেয় এটা হলের সবাই জানে। রিপন চিন্তিত হয়ে বলে ‘তাহলে উপায়’? ভুতেরা মনে হয় আমাদের ছাড়বে না। লিয়ন বলে পাশের পাড়ায় নাকি মাটি বাবার দরবার। বাবা মাটি পড়া দিলেই সব সমস্যার সমধান হয়। রিপন বলল চল যাই। কিন্তু সাদিক পা ব্যাথার কথা বলে যেতে চাইল না। মাটি বাবার দরবার শরিফে প্রচুর ভির। বাবা গেরুয়া রঙের কাপড় পরে ধ্যানে আছেন। তার চারিপাশে অসংখ্য ভক্ত কুল। রোগীরা লাইন ধরে আছে। বাবা সবার সমস্যার কথা শুনছেন আর ঔষধ দিচ্ছেন। ভিড়ের কারনে বাবাকে ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছিল না। অবশেষ বাবার দেখা পায় রিপন আর লিয়ন। তারা বাবার পায়ে পরে সব ঘটনা খুলে বলে। বাবা এবার নানা রকম মাটি বের করেন। কোনটা ড্রেনের পচা মাটি, কোনটা কাদা মাটি। সেগুলো থেকে গন্ধ আসছিল। ড্রেনের মাটির দিকে নির্দেশ করে বাবা দুজনকে বললেন ‘খা। ভুত প্রেত সব পালাবে’। রিপন বলল, ‘বাবা মাটি থেকে তো গন্ধ আসে’। বাবা এবার রেগে গিয়ে দুজন ভক্তকে আদেশ দেন ‘এই এদের মাটি খাওয়া’। লিয়ন এবার রিপনকে বলে ‘ওই সালা পালা’। দুজনেই দৌর। বাবা এবার তার ভক্তদয়কে আদেশ দেন ”ওই হারামিগো ধর, সালারা ট্যাকা দেয় নাই”। রিপন আর লিয়ন তখন দৌরের উপর।
আজ সারাটা দিন সাদিক ভুত নিয়ে নানা রকম বই, রিসার্চ পেপার, পত্রিকার রিপোর্ট সবই পড়েছে।অনেকগুলো দেশীয় ভুতের নাম জানা গেল।যেমন, পেত্নী, শাকচুন্নি, চোরাচুন্নি, পেঁচাপেঁচি, মেছোভূত, দেও, নিশি, গেছোভূত, কবন্ধ, ডাকিনী ইত্যাদি ইত্যাদি। বিদেশী ভুতেরও নাম আছে। আবার স্থান অনুসারে তাদের ধরন ও কাজ আলাদা।যেমন মিসরের পিরামিডের ভুত। ভুতেদের এই সব নাম আর আচার আচারন সবগুলি আলাদা আলাদা। সাদিক এবার ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়া শুরু করল। এখানে ভুতেদের বলা হয়েছে জীন নামে যারা অদৃশ্য শক্তি এবং আগুনের তৈরি। এরা বিভিন্ন রুপ ধারন করতে পারে। জিনেদের মধ্যে ভাল মন্দ দুটোই আছে। এরা গাছ, পানি (নদী/সমুদ্র) থাকে।
রাতের বেলা সাদিক শুয়ে আছে। আজ লিয়ন আর রিপন দুজনেই ভুতের ভয়ে পাশের রুমে শুয়েছে। সাদিকের ভুত সম্পর্কে আগ্রহটা একটু বেশি। কিন্তু আজ জানালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে জানালা দিয়ে ভুত ভয় দেখাতে না পারে। সাদিক আজ সাঁড়াশী অভিযানে নেমেছে। সে রুমে সেট করে রেখেছে ডিজিটাল ইনফ্রারেড ক্যামেরা একে থার্মাল ইমেজারও বলা হয়। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও এই ধরনের ক্যামেরার সাহায্যে মোটামুটি স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব। ফলে অন্ধকারের মধ্যেও ‘প্যারানরমাল ভিডিও ডকুমেন্টেশন’-এ সুবিধে হয় এই ক্যামেরার সাহায্যে। তার পকেটে আছে এক্সটার্নাল থার্মোমিটার। এটি ‘প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন’-এর ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। ভূত-সন্ধানীদের মতে, কোনও স্থানের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক রকমের দ্রুত পরিবর্তন হয়ে আসলে সেখানে প্রেতাত্মার উপস্থিতিরই ইঙ্গিত।আরও আছে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টর । এই যন্ত্রটির আরেক নাম ইএমএফ মিটার। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটররা মনে করেন আত্মার উপস্থিতি বা কোনও অস্বাভাবিক কার্যকলাপ নাকি ধরা পড়ে এই যন্ত্রে।
যন্ত্রগুলি সংরহ করেছে তার হলেরই আরেক বড় ভাইয়ের থেকে। তবে তাকে খুজে পেতে হয়েছে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে। তাকে সাদিক এমনি মুখে চিনত। কিন্তু তিনি যে ভুতের কারবার করেন আর ফেসবুকে একটা ভুত খুজে বেড়ানো লোকেদের নিয়ে গ্রুপ চালান এইটা জানত না। যাইহোক ভুতের কথা শুনতেই উনি সাগ্রহে যন্ত্রগুলি দিয়ে দিলেন। সাদিককে বুঝিয়েও দিলেন কোনটা কিভাবে চালাতে হয়। ভুতেদের আচারন, অভিব্যাক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি সম্বন্ধে। তবে মজার কথা হল তারা মানে প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটররা ভুতেদের মৃত মানুষের আত্তা মনে করে থাকেন। যাক সে কথা।
অনেকক্ষণ হল সাদিক শুয়ে আছে। কিন্তু ভুতের দেখা নেই। তার হার্টবিট ভেরি ফাস্ট। সাদিকের গা ছম ছম করছিল। হঠাৎ বাথরুমে মনে হচ্ছিল বাথরুমে কেউ যেন টিপকল চালু করে দিয়েছে। বাথরুম থেকে হাটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এইরকম কিছুক্ষন চলার পর সব শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। জানালার ফাক দিয়ে সেদিনের মত আলো আসতে লাগল। কিছুক্ষন পর জানালাটা ঘড় ঘড় শব্দ করে খুলে গেল। সাদিক ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে মাথা তুলে বাগানের দিকে তাকাল। আজ মেয়েটা তাকে হাতের ইশারায় ডাকছে। সাদিক ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে এগুয়। জানালার কাছে জেতেই জানালার গ্রিলগুলো হাওয়া হয়ে যায়। সাদিক ভয়ে ভয়ে জানালা টপকে চলে যায়। জানালার সাথেই আমবাগান। লাফ দিয়েই সামনে তাকায় সাদিক। চমকে যায়। চারদিকে পূর্ণিমার ঝলমলে আলো। এইরকম আলো কখনও সে দেখেনি। চারদিকে ঝাকে ঝাকে জোনাকি পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে। বাগানের ভেতর পচা পুকুরের পানি হয়ে গেছে টলমলে। তাতে ভাসছে শাপলা ফুল। অদ্ভুত একধরনের আলো গাছের সারির ফাক দিয়ে এসে পড়েছে।তার ভেতর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সে পরিটি। আজ তার গায়ে পাখা। যেন কল্পনার রাজ্য। তার ভয় উবে যায়। সে হাত দুটো বাতাসে ছেড়ে দেয়। অবকা হয়ে যায় সে। কারন সেও উড়তে পারছে বাতাসে। হঠাৎ উড়তে পারায় এদিক সেদিক ইচ্ছেমত উড়তে তাহকে সে। পরীটিকে ধন্যবাদ জানায় সে। কিন্তু এই দিকে তার বন্ধুরা আচমকা তাকে তাকে খুজতে থাকে। তাদের টর্চের আলো দেখা যাচ্ছিল। জঙ্গলে সাদিককে তার বন্ধুরা দেখলে বিপদ।
মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে পরীটির দিকে তাকায় সাদিক। পরীটি মৃদু হেসে তাকে চোখ বন্ধ করতে বলে। চোখ খুলতেই সে নিজেকে তার বিছানায় আবিস্কার করে।
সাদিককে খুজতে বেরিয়েছিল রিপন, লিয়ন আর সেই প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর বড় ভাই আরিফ। সাদিক বিষয়টা নিজেই হ্যান্ডেল করতে চেয়েছিল এবং এগুচ্ছিল ঠিক সেই ভাবে কিন্তু সব গোলমাল পাকিয়ে দিল আরিফ।
আরিফ রিপন এবং লিয়ন তিজনই এবার সাদিকের রুমে। ওই তিনজনের’ই এমন ভাব করল যেন তারা গোয়েন্দা আর সাদিক ক্রিমিন্যাল।কিন্তু পরীটার চালাকির কারনে মাঝখানে ফেসে গেল রিপন। কারন সেই খবর দিয়েছিল বাকী দুজনকে এই বলে যে, সাদিক রুমে নেই। ওর তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যে প্রমানিত হওয়ায় ওর ওপর কিছুক্ষন ফায়ারিং চলল তারপর আরিফ সাহেব শুরু করলেন তার প্রতিদেনের অভ্যাস ‘জ্ঞান বিতরন’। আরিফ তার মস্তিষ্কের ঝাপি খুলে বলে চলল- প্রাচীনকালে বহু সমুদ্রযাত্রী পরী দেখার বর্ণনা দিয়েছেন। স্যার আর্থার কোনাল ডয়েল ‘ফ্রেন্সেস অ্যান্ড ড্যান্সিং ফেইরিস’ ছবিটিকে সত্যিকারের পরীর ছবি বলে মত দিয়েছিলেন। পরী নিয়ে বাস্তবতার প্রথম ছবি হিসেবে এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। সেই ছবিতে ফ্রেন্সেসের সঙ্গে নাচে গানে মত্ত একদল পরীকে দেখা যায়।
লিয়ন এবার বলে উঠল, ”ভাই এবার থামেন”। আরিফ সাহেবের সেদিকে খেয়াল নেই। তার জ্ঞানের ঝাপির মুখ বন্ধ হল না।তিনি বলে চললেন, ”পরীদের নিয়ে বিজ্ঞানের যাত্রাও কম নয়। স্পষ্ট করে বললে, বিজ্ঞান এখনো পরীর দেখা পায়নি। তবে পরী সদৃশ জীবের দেখা হরহামেশাই মিলছে। যদিও সেগুলো নেহায়েতই পরী বা সদৃশ প্রাণী। পরী বলতে মানুষের যে গল্প তার ধারেকাছেও নেই সেগুলো। তবে চমকে ওঠার মতো পরীদের দেখা কিন্তু কদিন পরপরই মিলছে। গত বছরই ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনে পরীর ছবি তুলে চমকে দিয়েছেন লিসা। তার আগের বছর ২০১৪ সাল। সে বছর চেস্টার নিবাসী লুসিয়া কোরডারো ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নন। তিনি বিজ্ঞানের মুখের ওপর ছুড়ে দিলেন কয়েক মিনিটের ভিডিও। বাড়ির সিসি ক্যামেরা ফুটেজে ধরা পড়ল উড়ন্ত এক পরী”। আরিফ জ্ঞান দান শেষে চেয়ে দেখল কেউ নেই। আরিফের জ্ঞান আউট অফ ড্যাঞ্জারে পরিনত হচ্ছিল। তাই সবাই ভেগেছে। বিষয়টা উদ্বেগজনক। আরিফের জ্ঞানদান বিষয়ের উপর একটা ইনভেস্টিগেশন করা যেতে পারে।
সাদিক যন্ত্রগুলো চেক করল। ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোন কিছুই ধরা পরে নি। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টরও ফলাফল শুন্য। মনে হচ্ছে এসব দিয়ে আর কোন কাজ হবে না। সব খুলে ফেলে। সাদিক শুয়ে পরে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে।
পরদিন রাতে আবার একই ঘটনা ঘটে। সাদিক আবারো চলে আসে। আজকের গলপটা ভিন্ন। জঙ্গলটা চারদিকে অদ্ভুত সব আলো দিয়ে ভরে গেছে। পরীটার পড়নে আজও শুভ্র সিল্কের জামা। আজ তার পায়ে নুপুর। সে নুপুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।পরীটা পুকুরের পারে বসে পুকুরের জলে পা ভেজাচ্ছিল। একে বলে জল খেলি। অনেক আগে জমিদার কন্যারা পুকুরের ধারে বসে জল নিয়ে খেলা করত। আজ পুকরে ধব ধবে সাদা রঙের দুটো রাজাহাস। রাজাহাসের চারদিকে আলোয় ভরে আছে।পরীদের নাকি হিপনোটিজম করার ক্ষমতা থাকে।
যখনই পরীটা আসে তখনি সাদিকের কেমন যেন টান অনুভব করে। আর সেই টানেই সে চলতে শুরু করে।
চারদিক থেকে অদ্ভুত সব শব্দ আসছে। যাকে বলা যেতে পারে মায়াবী শব্দ। সাদিক আনমনে পরীটার প্রেমে পরে যায়। সাদিক যখন পরীটার চোখের দিকে তাকাত মনে হত তার চোখে লুকিয়ে কত শত বছরের রহস্য। তার চোখের রঙ অদ্ভুত রকমের। পরীটা যখন হাসত মনে হত তার হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হত পুরো বাগান জুড়ে। তার শরীর থেকে শুভ্র আলো বিচ্ছুরিত হত। প্রত্যেকদিন সাদিক পরীটার সাথে গল্প করত। পরীটা সব বলত।
তার বয়স ২০০।জীন পরীদের ভেতর ২০০ বছর হলে তাকে যুবতি ধরা হয়। পরিরা হাজার হাজার বছর বাচে। তার বাবা ছিল জিনেদের বাদশা। তারা বাবা মারা যাবার পর সব ওলট পালট হয়। বেশিরভাগ জিনেরা মানুষদের ঘৃণা করত। তার বাবার মৃত্যুর পরই জঙ্গল কেটে বানানো হল বিশ্ববিদ্যালয়। সব জীন পরী চলে গেল। রয়ে গেল শুধু তাদের রাজকুমারী। রাজকুমারী বড় একা পরে গেল। প্রথম প্রথম সব মানুষদের ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইত রাজকুমারী। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ সম্পর্কে তার ধারনে পাল্টে যায়। মানুষদের ভাল দিকগুলি তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। একাকীত্ব ঘোচাতে সে মানুষের বন্ধু হতে চাইত। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ ভুতে ভয় পায়। আর বিপত্তিটা এখানেই।
তবে এখন সে একজন বন্ধু পেয়ে গেছে।
কিছুদিন হল রিপন লিয়ন সাদিকের রুমে থাকে না। কারন তাদের সাথে ঘটেছে অদ্ভুত সব ভূতুরে কাণ্ড। হলের অনেকের ভেতর জানাজানি হওয়ার পর এই রুমে আর কেউ আসতে চায় না। ব্যাপরটা অবশ্য সাদিকের জন্য সুভিদার। প্রতি রাতেই পরীটার সাথে আরিফের আড্ডা জমত। ওই পুকুর পারে। সাদিক সারাদিন ক্লাসে ঘটা সব গল্প বলত আর পরীটা বলত গত দুশো বছরে তার সাথে ঘটা নানা রকম ঘটনা। তাদের আড্ডা চলত একেবারে ভোর পর্যন্ত। দিনের বেলা নাকি পরীদের ক্ষমতা থাকে না, তাই তারা দৃশ্যমান হতে পারে না।তাই পরীটা দিনের আলো ফোটার আগেই চলে যেত। তাদের বন্ধুত্বটা গাড় থেকে গাড়তর হয় । কিন্তু সাদিকের রহস্যজনক আচারনের খবর তার বাবার কানে কেমন করে যেন চলে যায়।
পরদিন ছুটির পর হল রুমে মিটিং বসেছে। উপস্থিত আছে তিন জন বিশেষজ্ঞ ও একজন গবেষক। এদের ভেতর আরিফ সাহেব গবেষক মানে সভার মধ্যমণি। আরিফ সাহেব এবার শুরু করলেন। তিনি নাকি শুনেছেন এর আগেই প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম পূর্ণিমায় ওই পরীর শিকার হত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন একজন ছাত্র। প্রথম ছাত্রর শেষ পরিণতি হয়েছিল মৃত্যু আর বাকিরা প্রত্যেকদিন জ্ঞান হারাত। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়বার পড়ই তারা পরীটার হাত থেকে ছাড়া পেত। সাদিক বিশ্বাস করতে চায় নি। কিন্তু আরিফ যখন প্রত্যেকের নাম আর বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের তারিখের একটা লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিল তখন সাদিক পিলে চমকে গেল। সাদিকের মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে পরীটা আমার কোন ক্ষতি করছে না কেন? তার উত্তরটা আরিফ দিল। পরীরা দুই কারনে কোন মানুষের ক্ষতি কারে না এক যখন তাদের কাউকে খুব ভাল লাগে দুই যখন কোন কাজে ওই মানুষটা তাদের হেল্প করতে পারে। পরীটা তোমার থেকে হয় কোন হেল্প চাইছে নয়তো তোমাকে সে পছন্দ করেছে।কারন সে যাদের প্রত্যেকের ক্ষতি করেছে সেই মাসটা ছিল বৈশাখ। যদি সে তোমাকে পছন্দ করে তাহলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে খুব খারাপ সংবাদ। কারন প্রথম ছেলেটিকে সে পছন্দ করেছিল।
আরিফ কিছুক্ষন চিন্তা করে জানাল আজ পরীটার সাথে তোমার দেখা না করাটাই ভাল। আজকের তারিখটা খেয়াল কর ২৩ শে মে।এবার লিস্টটার দিকে নজর দাও। সাদিকের লোম দাড়িয়ে যায়। কারন এই তারিখেই প্রথম ছেলেটির রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে। তবে তখন সে তার গ্রামের বাড়িতে ছিল। সেদিন নাকি অনেকেই বাগান থেকে নুপুরের শব্দ পেয়েছিল। শব্দ থামার সাথে সাথেই প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল।
না আজ কোন ঝড় ওঠে নি। কেউ নুপুরের শব্দও পায় নি।
গভীর রাত। সাদিক আর পরীটার আড্ডা আজও চলছে। সাদিক আরিফের বারন শোনেনি। এবার সে সরাসরি পরীটাকে প্রশ্ন করে সে তাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা। পরীটা কথাটা এড়িয়ে যেতে চায়। আরিফের জোরাজুরিতে পরীটা বলতে শুরু করে।
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে আমি একজনকে ভালবেসে ফেলেছিলাম, ওর নাম ছিল রায়ান। ছুটিতে সে গ্রামে চলে যায়। তারপর সে আর ফিরে আসে নি। সবাই বলে ও মারা গেছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। ওদের গ্রামটা ছিল আরেক জীন রাজার রাজ্য। পরীদের চলাচলের জায়গা সীমাবদ্ধ। সে শুধু তার রাজ্যের ভেতর চলাচল করতে পারবে। যদি সে অন্য রাজ্যে যেতে চায় তবে তকে সেই রাজার অধিনে যেতে হবে। কিন্তু আমি সেটা পারব না কারন আমি একটা রাজ্যের রাজকুমারী অন্য রাজ্যের রাজার অধিনে যেতে পারিনা। তাই রায়ান এখন বেঁচে আছে না মরে গেছে তা এখনও আমি জানিনা। রায়ানের অনুপস্থিতি আমার কষ্ট দিনকে দিন বাড়িয়ে তুলছিল। তাই খারাপ মানুষ দেখলেই আমি তাদের শাস্তি দিয়ে নিজের রাগ আর কষ্ট মেটাতাম।
পরীটার চোখে জল চলে এসেছে। বেশির ভাগ ছেলেরা নাকি মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা নাকি তাদের সে ক্ষমতাটা দেন নি। সাদিকের চোখেও জল চলে এসেছে। তবে তার কষ্টটা ভিন্ন। পরীটাকে বোধ সেই তার হৃদয় পাতার কোন এক অংশে স্থান দিয়ে ফেলেছিল। তাকে সে হারিয়ে ফেলল বোধহয়।
রাত তিনটা। সাদিক চিন্তায় ডুবে আছে। রায়ানের ঠিকানা কি ভাবে পাবে সে। প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা। তাই আরিফ ছেলেটার নামটাও ভুল বলেছিল। লিস্টে নাম ছিল হাসান। পুরনো ছাত্রদের নাম ঠিকানা থাকে লাইব্রেরীর রেকর্ড রুমে।ওখানে সারা রাত পাহারা থাকে। তাই ভোরবেলা হচ্ছে আদর্শ সময়। কারন ভোরবেলা রক্ষিরা ঘুমতে যায়। অনেক কস্টে তার নাম আর ঠিকানা বের করে রেকর্ড ফাইল থেকে। রেকর্ড রুম থেকে ফাইল চুরি করতে তাদের কম বেগ পেতে হয় নি। সে বিরাট গল্প। ওর সাথে ছিল আরিফ, লিয়ন আর রিপন।
পরদিন ঠিকানা ধরে বাসে চেপে চলে যায় সোজা রায়ানের বাড়ি। প্রায় ছয় ঘণ্টা লেগেছিল। কিন্তু ওদের বাড়িটা ছিল তালাবদ্ধ। কারণটা জানা গেল প্রতবেসিদের থেকে। মজার কথা হল গ্রামে সবাই রায়ানকে হাসান নামে চেনে। সে ক্ষেত্রে বলা চলে আরিফের সুত্র ভুল ছিল না। রায়ানের নিজের মা গত হন তার জন্মের সময়। বাবা বিয়ে করেন। তার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরার সময় বাবাও গত হন। এরপর একদিন হঠাত রায়ান অসুস্থ হয়। হাসপাতালের পথে সে মারা যায়। ময়নাতদন্তে তার শরীরে বিষ পাওয়া যায়। কিছুদিনের ভেতরে জানা যায় আরেক তথ্য। মৃত্যুর আগে রায়ানের বাবা রায়ানের নামে সব জমি লিখে দেন। আর এটা জানাজানি হবার পর রায়ানের সৎ মা পালিয়ে যান। কারন জমির লোভেই রায়ানের সৎ মা রায়ানের খাবার পানিতে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলেন। তখন থেকেই বাড়ি তালাবদ্ধ।
পরদিন রাতে পরীটা সব শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। তারপর একটা বিশাল ঝড় ওঠে। আর সেই ঝড়ের পর সাদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরী কোন মানুষকে ছেড়ে চলে গেলে নাকি ওই মানুষটা জ্ঞান হারায়। এরপর পরীটাকে আর খুজে পায়নি সাদিক।
আরিফের ধারনা হাসানের মৃত্যুর ঘটনাটা শুনে মানুষের প্রতি তার প্রচন্ড ঘৃণা জমে সেই কষ্টেই সে হারিয়ে গেছে।নিজের প্রয়জনে মানুষ সত্যি স্বার্থপর হয় ।
আর তার বন্ধুরাও তাকে ওই রুমে আর থাকতে দেয় না। ওই রুমেই ছিল রায়ান।রায়ান সাদিক আর পরীটার এই ঘটনাটা গল্পয়াকারে ভার্সিটির ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। আর এরপরই হল কৃতপক্ষ আজীবনের জন্য ওই রুমটি সিলগালা করে দেয়।