কামাল চৌধুরীর কবিতা: বিষয়ে প্রকরণে
মোহাম্মদ নূরুল হক
আধুনিক বাংলা কবিতায় গ্রামীণ পটভূমির সঙ্গে নগরের রূঢ়-চিত্রের সম্মিলিত রূপায়ণ ঘটনার প্রবণতা লক্ষণীয়। এই সমন্বয় সাধনে যে কবি যতটা পারঙ্গম, তিনি ততটাই বুদ্ধির দীপ্তি, মনীষার কান্তি ও হৃদয়-আবেগের নিরিখে সফল। কবি শব্দের স্রষ্টা যেমন, তেমনি ব্যাখ্যাকারও। একইসঙ্গে ব্যাখ্যাতীত অনুভব লালনকারী ও বাসনার উদ্গাতাও। এই কারণে খুব সাধারণ-নিত্যব্যবহার্য শব্দও প্রয়োগগুণে নতুন প্রাণ, অর্থ ও মাত্রা। যে জীবন মানুষ যাপন করে, তার যেমন বর্তমান আছে, তেমনি আছে ভবিষ্যৎ থাকারও সমূহ সম্ভাবনা। আর অতীত ছাড়া তো সেই জীবনপ্রবাহের মালা গাঁথা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই মানুষ মাত্রই অতীতচারী হয়। ফেলে আসা সময়ের জন্য তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। আর তখনই আত্মজিজ্ঞাসায় তাড়িত হয়।
মানুষের সবচেয়ে বড় কাজ বোধ হয় আত্মসমালোচনা। একইসঙ্গে অবসরে নিজের জীবনের হিসাব মেলানোও। যে মানুষ স্বামী-প্রেমিক, স্ত্রী-প্রেমিকা, বাবা-মা, যে মানুষ সমাজসেবক—তাকে সমাজচিন্তা-রাষ্ট্রচিন্তা পরিবারপ্রীতি আচ্ছন্ন না করে পারে না। কামাল চৌধুরীর কবিতা পাঠ করতে করতে উল্লিখিত বিষয়গুলো মনে এলো।
তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
ক. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ
খ. প্রেম-বিরহ থেকে রাজনীতি-দেশপ্রেম
গ. ঐতিহ্যপ্রেম
ঘ. যুক্তির শৃঙ্খলা ও মনীষার সমন্বয়
কামাল চৌধুরী ছন্দে সিদ্ধহস্ত—নিয়মনিষ্ঠ। তাই কবিতায় ছন্দচর্চাকেই ব্রত মেনেছেন। তিনি ছন্দজ্ঞানকেই কবির প্রধান অভিজ্ঞান বলে ধরে নিয়েছেন। কারণ, ‘কবিতার প্রতি মানবমনের যে অনুরাগ, তা ছন্দের ওপর নির্ভরশীল। ছন্দের ত্রুটিযুক্ত অথচ ভাবপূর্ণ কবিতা পাঠকের মনে আনন্দের সঞ্চার করতে সমর্থ হয় না।’১ তবে, স্বরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত— এই তিন ছন্দেই তিনি স্বচ্ছন্দ। এসব ছন্দে ছোট ছোট কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি রচনা করেছেন দীর্ঘ দীর্ঘ কবিতাও।
কামাল চৌধুরী ছোট-ছোট কবিতায় যেন স্বতঃস্ফূর্ত, তেমনি দীর্ঘ কবিতায়ও। তার কবিতাগুলো হয়ে ওঠে সুউচ্চ পর্বত থেকে বয়ে চলা ঝর্ণার মতো। জড়তা-বাধাহীন প্রবহমান। তেমনই একটি দীর্ঘ কবিতার নাম ‘রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা’। এই কবিতায় শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিরোমন্থনের পাশাপাশি রয়েছে যৌবনের রঙিন দিনগুলোর স্বপ্নবোনা। বয়ঃসন্ধির মনস্তত্ত্ব, সামাজিক বিধি-নিষেধের তর্জনীর পাশাপাশি অপ্রাপ্তির হাহাকারও উঠে এসেছে কবিতার শুরুতেই। বলেছেন,
তুমি পড়বে না জানি, তবু এই চিঠিখানি পাঠিয়ে দিলাম।
আমার জন্মের সাথে যে শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে
এ- মাটি শুনেছে যার অসহায় অবুঝ চিৎকার
আমি সেই ক্ষুব্ধ শিশু ক্রমান্বয়ে বিশেষ যুবক
অতৃপ্ত চরণে আজ লিখে দেবো পিতৃ-মাতৃঋণ
কিছুটা জন্মের ক্ষোভ, শোক, দাহ—কবির প্রণয়।
(রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা)২
কবিতাটিতে ব্যক্তির শৈশব থেকে পূর্ণযৌবনকালব্যাপী তার দেখা দেশ, সময় ও পরিবেশের বর্ণনা রয়েছে। দীর্ঘাঙ্গী এই কবিতাটি শুরু হয়েছে অনেকটাই মহাকাব্যের ধাঁচে। তবে, মহাকাব্য না হলেও তার বীররস, শৃঙ্গাররস, শান্তরসের বিপুল ব্যবহারে এটি গীতিকবিতার সীমা উৎরে গেছে। কবিতাটিতে রয়েছে দীর্ঘ পরিভ্রমণ, যে পর্যটনে কবি একা নন, তাঁর মানসগোষ্ঠী, তাঁর সম্প্রদায়কেও সঙ্গী করা হয়েছে। তবে, দীর্ঘ যাত্রাপথে কবি বারবারই মানুষের সন্ধান করেছেন। মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়ার প্রত্যাশায় থেকেছেন। বলেছেন,
একটি সড়ক ধরে বহুদিন একা হেঁটে গেছি
আজো আমি একা যাই একজন সাথী তো দেখি না
ভালোবাসা যার নাম সেইপথ মনুষ্যবিহীন
মানুষ কখন ছিল? মৃত্তিকায়—ধান দূর্বাঘাসে?৩
এই কবিতায় এমন আকুতি ও হাহাকারের পাশাপাশি কামাল চৌধুরী তুলে ধরছেন বাঙালির সহজাত প্রবণতা। একইসঙ্গে অকৃতজ্ঞ ও হন্তারক-হৃদয়হীন মানুষের অমানবিক আচরণেরও চিত্র এঁকেছেন। সবশেষে আহ্বান করেছেন বাঙালির সাহিত্যিক-রাজনৈতিক চিরদ্রোহের কবি, মানবতা ও প্রেমের কবি কাজী নজরুলকে। বলেছেন, ‘গান ধরো নজরুল, একবার গান গেয়ে যাও/ ভেঙে ফেলি পোড়োবাড়ি, ভুল ঘর, মুখোশী প্রণয়।’৪ কাজী নজরুলকে গান গাওয়ার আহ্বান জানিয়েই কবি থেমে যাননি, বলেছেন, শেষ অভিমানের কথাও। ‘তুমি পড়বে না জানি, তবু এই চিঠিখানি পাঠিয়ে দিলাম।’৫ এখন প্রশ্ন জাগছে এই চিঠির প্রাপক কে? জবাবে এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে—প্রাপক বাংলা কবিতার পাঠক, রক্তেমাংসে বাঙালি; সর্বোপরি মানুষ। যদি কবি অভিমানে বলছেন, ‘তুমি পড়বে না জানি’; তবু একথাও সত্য—তিনি মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করেন না। কারণ এই কথা তার অভিমানের, বিশ্বাসের নয়। পাঠক, যিনি মানবতাবাদী, যে বাঙালি, তিনি অবশ্যই নিজের শেকড়ের সন্ধান পাওয়ার কাক্সক্ষায় এই মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাঋদ্ধ চিঠি পড়বেন। পড়বেন, আর নিজের পূর্বপুরুষ, নিজের চিরায়ত বাংলা, বাংলার সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শ্রমজীবী সমাজ, রাজনীতি, স্বাধিকার আন্দোলনের স্মৃতিরোমন্থন করে গৌরববোধ করবেন। অক্ষরবৃত্তের মধ্যম লয়ের চালের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অলঙ্কারের ব্যবহারে কবিতাটি সত্যিকার অর্থেই মহাকাব্যেরই স্বতন্ত্র একটি স্বর্গের সমান গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে—একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
দুটি অলঙ্কারের উদাহরণ দেওয়া যাক:
ক. কালো কালো কাক এসে বসে থাকে স্মৃতির সভায় (চিত্রকল্প ও অনুপ্রাস)
খ. আসাদ আমার ভাই, চিরযুবা আমিও আসাদ (উপমা)
প্রথম উদাহরণে ‘কালো কালো কাক’ শব্দগুচ্ছে ‘ক’ ধ্বনির বারংবার উচ্চারণে অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে। আবার পুরো চরণ ‘কালো কালো কাক এসে বসে থাকে স্মৃতির সভায়’ বলার ভেতর দিয়ে বিদ্রূপাত্মক চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণে ‘চিরযুবা আমিও আসাদ’ বলার ভেতর দিয়ে তুলনাবাচক অর্থালঙ্কার অর্থাৎ উপমা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ‘মতো’, ‘যেন’ শব্দের ব্যবহার ছাড়াই কবি উপমা সৃষ্টি করার দক্ষতা দেখিয়েছেন।
কামাল চৌধুরীর কবিতার বিষয় মানব-মানবীর প্রেম থেকে দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রীতি থেকে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বিষয়ের মতো বিচিত্র প্রপঞ্চ। ‘সেই মুখখানি স্বাধীনতা প্রিয় ছিল’ কবিতাটি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে রচিত মনে হলেও এতে ভিন্নমাত্রা যুক্ত আছে। এই কবিতায় বাংলার হাজারো লড়াকু সৈনিকের কথা বর্ণনা করা হয়েছে ‘সেই মুখখানি’ শীর্ষক প্রতীকী সত্তার আড়ালে। তাই কবিতাটি হয়ে উঠেছে বিচিত্রমুখী।
‘দিনকাল’কে আপাত প্রেমের কবিতা মনে হলেও আদতে তা নয়। এই কবিতায় মূলত মানুষের জীবন-সংগ্রাম বিধৃতি হয়েছে।
আমরা দুজন ধুলোর ভেতর হেঁটে
পা ধুতে যাই সুদূর অতীতকালে
অতীত তখন শুভ্রডানায় মেঘ
ঠোঁট এঁকে দেয় অগ্নিনদীর গালে।
অতীত আলোর আগুন ভরা ভোর
পেরিয়ে আসি দূর আগামীর দিনে
প্রাণসজনী সাঁজবেলাকার পাখি
বললে, আজো চিনতে কি পারলি নে?
(দিনকাল)৬
‘প্রতিশোধ’ কবিতাও প্রায় সমধর্মী রচনা। এখানে মানবজীবনের সংঘর্ষপ্রিয়তাকে মহিমান্বিত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রথম পুরুষ যদি জীবনসংঘর্ষে সফল হতে না-ও পারে, তাহলে সে তার উত্তরপুরুষের কাছে সেই দায়িত্ব অর্পণ করে যাবে। অর্থাৎ জীবনের সংঘর্ষ ও মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের যে পরম্পরা তা আবহমানকাল ধরেই বহমান। এই চিত্রটিই প্রতিশোধ কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
পাঁজরের হাড়ে আগুন জ্বালিয়ে আছি
ছাড়ব না আমি কিছুতেই ছাড়ব না
যতদিন বাঁচি গোত্রের প্রতিশোধ
রক্তবর্ণ ক্রোধ জ্বেলে জ্বেলে নেব
ছাড়ব না তবু কিছুতেই ছাড়ব না।
. . .
এ এক জীবনে যদিবা ব্যর্থ হই
এই তলোয়ার পুত্রকে দিয়ে যাব।
(প্রতিশোধ)৭
কবি যেমন সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক বিষয়ে কলম ধরেন, তেমনি ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিও প্রকাশ করেন। তবে, কবি তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করলেও তার ব্যক্তিগত বিষয় ছাপিয়ে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কবি বলেন নিজের কথা, পাঠক পাঠ করেন সবার বক্তব্য হিসেবেই। এখানেই ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে ওঠে সামষ্টিক প্রপঞ্চ। কামাল চৌধুরীও অনেক কবিতায় তাঁর ব্যক্তিগত প্রেম-বিরহ-সুখ-দুঃখকে কবিতার অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। তেমনই একটি কবিতার শিরোনাম ‘বিরহ’।
মরিনা আমরা আজো—বেঁচে থাকি নেশার আরকে
ভালোবাসা মনে গেলে রাত্রি থাকে আষাঢ় শাসিত
ত্রিশূলের রক্ত খেয়ে ধাঙড়ের শেষতম মদে
আমরা ভাসিয়ে রাখি দিগন্তের খরস্রোতা নদী।
(বিরহ)৮
কবিরা পাখির মতো স্বাধীনচেতা। তাঁরাও পাখির মতো আকাশে উড়তে চান। তাই পাখিদের যেমন কাঁটাতারে ঘেরা কোনো রাষ্ট্রীয় সীমারেখায় আটকে রাখা যায় না, তেমনি কবির চিন্তাকেও না। কবিও কাঁটাতারের সীমারেখার বিরুদ্ধে দ্রোহ করেন।
রাষ্ট্র যদি সীমারেখা, কবি তবে আরো দূরগামী
সবুজের জাত নেই, রক্তে কোনো অধর্ম থাকে না
মানচিত্রে নদী থাকে, সাদা কালো স্রোতে একাকার
জীবাশ্ম, উপলখণ্ড, সেইসঙ্গে নুড়ি, অণুজীব
সব ভাসে পদ্মাবক্ষে— গঙ্গানদী, ফোরাতের কূল
সবাই সাগর খোঁজে—জলভাগ মানবতাবাদী।
(কাঁটাতার)৯
কামাল চৌধুরীর সময়সচেতন কবি। তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক বিষয়াবলি যেমন গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তিনি কবিতার অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। ফলে তাঁর কবিতা ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠেছে। এই ধারার একটি কবিতা ‘বন্যা ১৯৯৮’। তবে এই কবিতা কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভিষীকা বর্ণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মানবসৃষ্ট দুর্যোগের বিরুদ্ধে কবির ক্ষোভ প্রকাশও এতে স্থান পেয়েছে। এই কবিতায় কামাল চৌধুরীর প্রার্থনা:
যেন মৃত্যুকে অস্বীকার করে মাতৃ-গর্ভে জেগে ওঠে শাশ্বত ভ্রূণ
যেন প্রতিটি জন্মই জলের মহিমা নিয়ে শুভ্র হয়ে ওঠে
যেন প্রতিটি জন্মই তার অভীষ্ট খুঁজে নিতে পারে…
(বন্যা ১৯৯৮)১০
তিনি এই প্রার্থনা কেন করেছেন, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পরবর্তী স্তবকে। বলছেন,
প্রার্থনা করেছি, কারণ জেনেছি জলেরও প্রাণ আছে
যে-রকম বৃক্ষ-লতা পাখিদের আছে
প্রভু মর্ত্যধামে জলকে দিয়েছেন অন্তরাত্মা; সে শুধু কলহাস্যে
মুখরিত করে রাখে উঠোন, বৃষ্টির রেখা ঘর বাড়ি
. শস্যময় চোখ
(বন্যা ১৯৯৮)১১
কামাল চৌধুরী কবিতাটি শেষ করেছেন মানবজীবনের অমোঘ সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। বলেছেন, ‘প্রশ্নগুলো থেকে যায়। মন শুধু রুটি ও আশ্রয় খোঁজে…।’১২ সময়চেতনা কালসচেতন কবির ধর্ম এই কথা সত্য। কিন্তু কবি মনোসমীক্ষণেরও নিরীক্ষা করেন, এই সত্য কালেভদ্রে ঘটে।
দিদির মতো শান্ত দিঘি। কারা খুঁজছে মুখ
গাছেরা সব দাঁড়িয়ে দেখে বিরহের অসুখ।
(বিসর্জন)১৩
মনোসমীক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনেরও চর্চা করেন কবি। ‘কবিতাংশ’ শীর্ষক কবিতায় তার এই দর্শনচর্চার ছাপ রয়েছে। কবিতাটির কিছু কিছু চরণ প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে। যেমন, প্রথম চরণ—‘গানেও মৃত্যুর সুর, সব গান জীবনের নয়।’১৪ এই কবিতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরণ:
ক. এই গান ক্ষণস্থায়ী, এই বর্ষা চির-জল নয়
খ. রন্ধন করেছি স্বপ্ন, গরিবেরা স্বপ্নে সুখী হয়
গ. আমরা ভাসাব তরি; অবলুপ্ত, প্রত্ন-খেয়াঘাট. . .
ঘ. যাব তবে অন্ধকার, এই পথ দিগন্তে মায়াবী
ঙ. বাজাও সমুদ্রভাষা—বুনোজল মুক্ত পাখি হোক।
চ. শোক ও প্রার্থনা শেষে ধূলি ওড়ে, কুয়াশা যুগের।
ছ. ছিলমা চাঁদের দেশে আরো দূর নক্ষত্রের পাশে
জ. অনার্য জাতির রক্তে লিখে রাখে দেশাত্মবোধন।
ঝ. আঁচল বিছিয়ে দিলে প্রেমপত্রে লিখি বাংলাভাষা
ঞ. পাশে যে অশোকগাছ তারো ফুলে আগুনের নেশা
বহ্নিমান, দাউ দাউ, রোদ-বৃষ্টি, অশ্রু-ছায়াতলে
এই দূর মফস্বলে, নববর্ষে—বাংলা-ভাষা-ফুল
আমৃত্যু ফুটতে থাকো—সুখী হোক বাঙালি জীবন।
(কবিতাংশ)১৫
এই কবিতার মানবজীবনের বিভিন্ন সময় ও ঘটনার সঙ্গে প্রকৃতির সাদৃশ্য তুলনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের প্রতি কবির প্রেম-শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধের প্রকাশ ঘটেছে। দেশপ্রেমের আরেকটি কবিতা ‘পতাকা’। এই কবিতায় দেশকে কবি পাঠশালার সঙ্গে তুলনা করেছন। বলেছেন,
তোমাকে আমার পাঠশালা মনে হয়
দিবা পাঠক্রমে, নিশিকালে পাই মা-কে
প্রেম লিখি, ধান, রবি-গান, শ্যামা পাখি
বাংলা বানানে লিখে রাখি পতাকাকে।
(পতাকা)১৬
বিষয় হিসেবে ‘চিত্রকল্প’ কবিতাটিও অভিনব। এই কবিতায় চিত্রকল্প সৃষ্টির প্রাচুর্য লক্ষণীয়।
আকাশের গায়ে ঠেস দিয়ে বসা রোদ
উকুন বাছছে মেয়ে মানুষের চুলে
আঙিনায় বাজে অলস ঘুঘুর ডাক
উদাসীন গাছে পাতা ঝরে পড়ে ভুলে।
(চিত্রকল্প)১৭
কামাল চৌধুরী স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধকে সবসময়ই হৃদয়ে লালন করেন। তাই বারবারই স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। ‘মার্চ’ কবিতাটিও সে চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
আকাশে বাতাসে মার্চের বরাভয়
মার্চ এসে গেছে জনতার চিৎকারে
প্রতিবাদী দেশ, প্রতিবাদী জনগণ
মার্চ এসে গেছে বাংলার ঘরে ঘরে
. . .
এই মার্চ মানে মুক্তি ও স্বাধীনতা
এই মার্চ মানে বাঙালির জয়গান
স্বদেশ আমার, সাহসে ও সংগ্রামে
আমরা সবাই মার্চের সন্তান।
(মার্চ)১৮
কামাল চৌধুরীর কবিতায় স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষর ও অক্ষরবৃত্তাশ্রয়ী গদ্যছন্দের প্রয়োগ রয়েছে। তিনি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তাশ্রয়ী গদ্যছন্দে তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। বিষয় ও বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছন্দকে ভাঙচুর করেছেন। তাঁর কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ ঘটেছে বিষয়-শব্দরাজির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। অন্ত্যমিল তো রয়েছেই, তবে তারও চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ধ্বনিসাম্যকে। ছন্দপ্রয়োগে তিনি নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। তাঁর কবিতায় ছন্দের নিপুণ প্রয়োগের কারণে ধ্বনি ও বাণীর সামঞ্জস্য মেলে। ফলে কবিতা পাঠকহৃদয়ে সহজেই দোলা দেয়। কারণ,
ছন্দ হলো ধ্বনি ও বাণীর মিলনসেতু। এই সেতু দিয়ে ধ্বনির রাজ্য পেরিয়ে বাণীর ভুবনে যে যত সহজেই প্রবেশ করতে পারবে, সে তত বেশি সিদ্ধি অর্জন করতে পারবে। অর্থাৎ পুরোপুরি ছন্দ আয়ত্ত করতে পারলে বাণীর মর্ম পাঠকহৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া সুকঠিন কোনো কাজ নয়। ছন্দ অবশ্যই শ্রুতিনির্ভর অনুষঙ্গ। কিন্তু তার গন্তব্য কেবল কানের দরজাতেই সীমাবদ্ধ নয়। কানের স্থূল পর্দা পার হয়ে বাণীর মর্ম নিয়ে পাঠকের হৃদয়মূলে প্রবেশ করাই হলো ছন্দের মুখ্য কাজ। তবে, সবটা তাও নয়। হৃদয়মূলে প্রবেল করলেই ছন্দের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং আরেক ধাপ ‘অগ্রসর পথের’ জন্ম হয়। কান হয়ে হৃদয়ে প্রবেশের পরই মস্তিষ্কে অনুরণন তোলার গুরুভার বহন করতে হয় তাকে। তবেই, ছন্দের একটি গুরু দায়িত্ব পালন করা হলো বলে ধরে নেওয়া যায়। ১৯
কামার চৌধুরীর কবিতায় ছন্দ কানের দাবি মিটিয়ে হৃদয়ের মর্মমূলকে পর্যন্ত স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
০১.
দিদির মতো শান্ত দিঘি। কারা খুঁজছে মুখ
গাছেরা সব দাঁড়িয়ে দেখে বিরহের অসুখ।
(বিসর্জন)
০২.
পাঁজরের হাড়ে আগুন জ্বালিয়ে আছি
ছাড়ব না আমি কিছুতেই ছাড়ব না
যতদিন বাঁচি গোত্রের প্রতিশোধ
রক্তবর্ণ ক্রোধ জ্বেলে জ্বেলে নেব
ছাড়ব না তবু কিছুতেই ছাড়ব না।
(প্রতিশোধ)
০৩.
পাশে যে অশোকগাছ তারো ফুলে আগুনের নেশা
বহ্নিমান, দাউ দাউ, রোদ-বৃষ্টি, অশ্রু-ছায়াতলে
এই দূর মফস্বলে, নববর্ষে—বাংলা-ভাষা-ফুল
আমৃত্যু ফুটতে থাকো—সুখী হোক বাঙালি জীবন।
(কবিতাংশ)
উল্লিখিত তিনটি উদাহরণের প্রথমটি স্বরবৃত্তে, দ্বিতীয়টি মাত্রাবৃত্তে এবং তৃতীয়টি অক্ষরবৃত্তে রচিত। ছন্দ তাঁর কবিতার বাণীর অনুগামী হয়ে চরণকে যেমন গীতল একটি সুর দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে বিষয়ের ঐশ্বর্য অনুযায়ী গাম্ভীর্য।
ছন্দের প্রয়োগ ছাড়াও বিষয় নির্বাচন ও ভাষাশৈলীতে বেশ সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তাঁর কবিতায় বুদ্ধির দীপ্তি যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় হৃদয়াবেগে মথিত হওয়ার বাসনাও। এ কারণে তাঁর কবিতা পাঠে মনে হয়—
কবিতা বুদ্ধিবৃত্তিকে সমীহ করে, ভালোবাসে সংবেদনশীলতাকেই। এ সবই ঘটে সময়ের রুচিভেদে, মানুষের চিরায়ত বাসনার সঙ্গে নিত্য-অনিত্য অভ্যাসের অভিঘাতে। সময়ের নির্দিষ্ট পরিচয় থাকে; থাকে বিশেষ সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশেষ চিত্রও। এ জন্য কবিকে হতে হয় কাল-সচেতন। ওই কালসীমায় অর্থনীতির আবর্তন এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণাও তার থাকতে হয়। যুগের পরিবর্তনে প্রধান নিয়ামক শক্তি অর্থ; আর্থিক নিশ্চয়তা কবিকে রাখে সক্রিয় এবং চিন্তাশীল। চিন্তা ও কল্পনার সক্রিয়তাই কবি সৃজনক্রিয়ার প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে। আধুনিক কালের কবির আশ্রয় যুক্তিহীন ভাবালুতা নয়; মনীষাশ্লিষ্ট অভিজ্ঞানে। আবেগের আতিশয্য নয়; সংহতিতেই তার স্বস্তি।২০
মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি ও মানব-মানবীর প্রেম, দর্শন যেখানে একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে, সেখানে কামাল চৌধুরীর কবিতা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতায় বল্লমের ফলার মতো তীক্ষè ধারযুক্ত বুদ্ধির দীপ্তির পাশাপাশি রয়েছে ক্ষীপ্র তীরের মতো লক্ষ্যভেদী নিশানাও। ফলে তাঁর কবিতা ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগে, প্রেম-বিরহ, রাজনীতি-দেশপ্রেম, ঐতিহ্যপ্রীতি, যুক্তির শৃঙ্খলা ও মনীষার সমন্বয়ে হয়ে উঠেছে ধবল জোছনা রাতে প্রান্তরে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা এক রহস্য মানবীর মতো আকর্ষণীয়।
তথ্যসূত্র
১. মাহবুবুল আলম, বাংলা ছন্দের রূপরেখা, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা ২০১৬, পৃ. ১১
২. কামাল চৌধুরী, নির্বাচিত কবিতা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১৩
৩. তদেব, পৃ. ১৫
৪. তদেব, পৃ. ১৬
৫. তদেব, পৃ. ১৬
৬. তদেব, পৃ. ২৪
৭. তদেব, পৃ. ৩১
৮. তদেব, পৃ. ৩৮
৯. তদেব, পৃ. ৬১
১০. তদেব, পৃ. ৬৪
১১. তদেব, পৃ. ৬৪
১২. তদেব, পৃ. ৬৬
১৩. তদেব, পৃ. ৭০
১৪. তদেব, পৃ. ৭৭
১৫. তদেব, পৃ. ৭৭-৮০
১৬. তদেব, পৃ. ৭৭
১৭. তদেব, পৃ. ১০০
১৮. তদেব, পৃ. ১০৯
১৯. মোহাম্মদ নূরুল হক, আধুনিক বাংলা কবিতা: ছন্দের অনুষঙ্গে, বাংলানামা, ২০২৪, পৃ. ১৯
২০. মোহাম্মদ নূরুল হক, কবিতার সময় ও মনীষার দান, বাংলানামা, ঢাকা, ২০২১, পৃ. ২০